দুলাল মিয়া::
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ। ইতিহাসের এক অগ্নিযুগ। এই অগ্নিযুগের অগ্নিসন্তান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম ও বিদ্রোহের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন ।
তিনি শুধু ‘বিদ্রোহী কবি’ নন - একই সঙ্গে তিনি প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি। তাঁর কাব্যে প্রেম ও বিদ্রোহ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং তারা একে অন্যের পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বলেছেন- “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য।” নজরুলের কবি চেতনার মূল উৎস যদিও রোমান্টিকতা; কিন্তু যেখানে এসে তিনি বাংলা কাব্যে যুগান্তর সৃষ্টি করেছেন, সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন সেটি তাঁর বিদ্রোহ। নজরুলের প্রথম কাব্য বিদ্রোহের ‘অগ্নিবীণা’।
এর মাধ্যমে তিনি তাঁর সমকালীন কবিদের মধ্যে বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্র পরিম-লে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন মূলত এই বিদ্রোহের জন্যই। নজরুল ইসলাম গভীরতরভাবে ছিলেন মানুষ ও মানবতার কবি। মানুষকে ভালোবেসে এবং মানুষের ভালোবাসা পেয়ে তিনি ধন্য হতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরে এক নতুন মর্যাদায় তিনিই সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ভারতবর্ষের এক যুগসন্ধিক্ষণে তিনি সঠিক অর্থে আবির্ভূত হন বাংলা কবিতায়। পরাধীন ভারতবর্ষ ও পরাধীন ভারতবাসী, ইংরেজদের অন্যায় -অত্যাচার, সমাজের অসাম্য, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ধর্মের নামে ভন্ডামি ও সাম্প্রদায়িকতা - মানুষের ভালোবাসার মধ্যে নজরুল এইসব প্রতিবন্ধকতা দেখতে পান। অপ্রেম, অসুন্দর আর অকল্যাণে ভরা সমাজ। তিনি প্রেম ও সুন্দরের সাধক। প্রেম ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই তিনি বিদ্রোহ করেন - অপ্রেম, অসুন্দর আর অকল্যাণের বিরুদ্ধে। সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মে যেখানেই কবি দেখেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল, সামাজিক বৈষম্য ও ধর্মের স্বার্থ বুদ্ধি সেখানেই হয়েছেন বিদ্রোহী ও বিপ্লবী। নজরুলের এ বিদ্রোহ প্রথম যে কাব্যে প্রকাশিত হয় তা তাঁর ‘অগ্নিবীণা’। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের প্রতিটি কবিতাই বিদ্রোহের। বিদ্রোহের বাণীকে উচ্ছ্বসিত করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন হিন্দু - মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের। যৌবনের অপরমিত উচ্ছ্বাসে হিন্দু - মুসলিম ঐতিহ্যের উপমা-রূপকে কবি তাঁর বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। সেকালে এই কবিতাটি এতো আলোড়ন তুলেছিল যে, এই বিশেষণটি এখনো নজরুলের নামের পূর্বে একটি রাজকীয় ভূষণের মতো শোভা বর্ধন করে আছে। কবি ব্যক্তিচিত্তের অনুভবে একটি সামগ্রিক বিদ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করেছেন - “বল বীর - বল চির উন্নত মম শির শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।” কবি নিজেকে বলেছেন- ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণি, উন্মাদ, দুরন্ত ও দুর্দম। তিনি অসাম্প্রদায়িক চিত্তে এবং ঐতিহ্য গ্রহণের মনন শক্তিতে হিন্দু ঐতিহ্যের যথার্থ ব্যবহারে তাঁর রাজনৈতিক বিদ্রোহকে শাণিতভাবে প্রকাশ করেছেন- “আমি পরশুরামের কঠোর কোঠার।” কিংবা “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন।” আবার, কোথাও কোথাও হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে মুসলিম ঐতিহ্যের অভিনব সমন্বয় সাধন করে বিদ্রোহ করেছেন সমগ্র জাতির - “ধরি বাসুকির ফণা জাপটি / ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি।” নজরুল তাঁর বিদ্রোহের মধ্যে অন্যতম উপজীব্য করেছিলেন তাঁর সমকালের মুসলিম জাতির জাগরণকে।তাঁর কিছু কবিতায় মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে সেই বিশেষ দিকটি রূপায়িত করেছেন। ‘আনোয়ার’ কবিতায় কবি ঘুমিয়ে পড়া স্বজাতির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন- “আনোয়ার! আনোয়ার! যে বলেছে মুসলিম- জিভ ধরে টানো তার! বেঈমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার।” অনুরূপভাবে মুসলিম জাতিকে জাগরণের আহ্বান জানিয়ে ‘কামাল পাশা’ কবিতায় বলেছেন - “কে মরেছে? কান্না কিসের? বেশ করেছে! দেশ বাঁচাতে আপনারই জান শেষ করেছে! বেশ করেছে!!” দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, ধর্মের ভন্ডামি ও নারীর প্রতি অবহেলা নজরুলকে করে তুলেছে মানবতাবাদী, সাম্যবাদী - যা নজরুলের বিদ্রোহের সাথে সংযুক্ত- “দেখিনু সেদিন রেলে কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?” কবি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে গভীর ভালোবেসে সকল অত্যাচার ও বঞ্চনা থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন - “আজ চারিদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারী জাত ও ভাই জোঁকের মত শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত।” মানুষের প্রতি প্রেম, দেশের প্রতি মমত্ব ও দায়িত্ববোধের কারণেই তিনি সকল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন- “যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।” ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার- নির্যাতন এবং রাজবন্দীদের উপর অমানসিক বর্বরতা যখন চরমে উঠেছিল, তখন তাঁর বিদ্রোহী সত্তা গর্জে ওঠে- “কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট।” ধ্বংসকে তিনি ভয় পান নি। কারণ ধ্বংসের মধ্য দিয়েই গড়ে তুলতে হবে নতুন জীবন এবং একমাত্র যৌবনই তা করতে পারে। নজরুলের বিদ্রোহ ভাঙতে চায় পুরাতন ও জীর্ণ সবকিছুকে। ভাঙ্গনের মাধ্যমে নব সৃষ্টির প্রেরণাই তাঁর বিদ্রোহের লক্ষ্য। তাঁর বিদ্রোহের মূল শক্তি যে যৌবন, সে কথা বলেছেন- “ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর! প্রলয় নতুন সৃজন বেদন, আসছে নবীন, জীবন হারা অসুন্দরের করতে ছেদন।” এই কঠোর উচ্চারণের পেছনেও রয়েছে- প্রেম, মানবতা, ন্যায় ও সমাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা। তাঁর বিদ্রোহ বিনাশের জন্য নয়, বরং তা সৃষ্টি ও রূপান্তরের জন্য। নজরুল বিশেষ কোনো ধর্মের কবি নন। স্বজাত্যবোধ ও জাতীয়তাবোধ ছিল তাঁর সহজাত। তাঁর বিদ্রোহ স¤পূর্ণভাবে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। সে বিদ্রোহ স্পষ্ট ও গভীরভাবে অসাম্প্রদায়িক ও ঐতিহ্যনির্ভর। সমকালীন আবেদন মিটিয়েও তাঁর বিদ্রোহ সর্বকালের, সর্বযুগের সকল মানুষের। কবির ভাষায় - “মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।” তাঁর বিদ্রোহের প্রধান গৌরব ও মহত্ত্ব এখানে যে, এ বিদ্রোহ অত্যাচারী নিধন না হওয়া পর্যন্ত কখনো ক্লান্ত ও শান্ত হবে না এবং সচেতন আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ মানব চিত্ত বিশ্বের সকল বন্ধন ছিন্ন করে অনন্ত প্রগতি লাভ করবে। নজরুল আগে প্রেমিক, পরে তূর্যবাদক বিদ্রোহী। তাঁর বিদ্রোহের রুদ্র ভাষার সাথে কোমল মধুরভাব পরিণয় স্বীকৃত। মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি ধূর্জটি, আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস প্রভৃতির পাশে - “আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!” নজরুল যখন তাঁর কবিতায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তখন তাঁর প্রেম আর বিদ্রোহ একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে- “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” এই চেতনাই তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য- দ্বন্দ্ব নয়, সংমিশ্রণ। নজরুলের কবিতায় প্রেম কোনো দুর্বলতা নয়, বরং শক্তির উৎস; আর বিদ্রোহ শুধু ধ্বংস নয়, তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রেমময় সংগ্রাম। নজরুলের কাব্যে প্রেম ও বিদ্রোহ কখনো একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান করেনি। প্রেম দিয়েছে বিদ্রোহকে মমত্ববোধ, আর বিদ্রোহ দিয়েছে প্রেমকে দৃঢ়তা ও চেতনা। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহ ও প্রেমের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। উভয়ের জন্ম একই উৎসে। প্রেম নিঃস্বার্থ, বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। এই দ্বন্দ্বহীন প্রেম-বিদ্রোহই নজরুলকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা।
[লেখক দুলাল মিয়া : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজ, ছাতক, সুনামগঞ্জ]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
নজরুল কাব্যে দ্বন্দ্বহীন প্রেম-বিদ্রোহ
- আপলোড সময় : ২৪-০৫-২০২৫ ১০:৫৯:৪০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-০৫-২০২৫ ১১:৫২:৩৮ অপরাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ