নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ ক্রমেই জটিল হচ্ছে
- আপলোড সময় : ২৩-০৫-২০২৫ ০৮:৩৩:৪৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৩-০৫-২০২৫ ০৮:৩৩:৪৮ পূর্বাহ্ন

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
জুলাই আন্দোলন চলাকালে এর নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর দৃশ্যমান সম্পর্ক ছিল বেশ সন্তোষজনক। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও প্রথম দিকে এ সম্পর্ক অটুট ছিল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে; জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন দল গঠন করেছে। বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী- এই তিন দল এখন তিন দিকে। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিতে রাজপথে চলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, এমনকি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন-অবরোধ-কলম বিরতি কর্মসূচি। এসব সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। তদুপরি সীমান্ত পরিস্থিতি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পুশইন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মানবিক করিডর ইস্যু, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়াসহ নানা ঘটনা নিয়ে নানা মতের জেরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়াচ্ছে উত্তেজনা। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাড ঘোষণা না করায় বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর মাঝে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে, যা আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের হিসাব-নিকাশকে অনেকটাই জটিল করে দিতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর জুলাই সনদ ঘোষণায় জামায়াত গণভোট দাবি করলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ দেখা দেয়। এদিকে জুলাই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে- এমন ফেসবুক পোস্ট দিলে ক্ষুব্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে টানা সাত দিন ধরে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে আদালতের রায় অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে জোরেশোরে রাজপথে নামে বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বসে নেই এনসিপিও। তারাও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দাবিতে গত বুধবার থেকে আন্দোলন শুরু করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে ইসি পুনর্গঠন ছাড়া নির্বাচন হবে না।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, আপাতদৃষ্টিতে দেশে যা ঘটছে তা দেখে মনে হয়, বিভেদ ও বিভাজন বেড়ে চলেছে। এটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। দেশের এ ক্রান্তিকালে সব রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজনৈতিক মতৈক্য অত্যন্ত জরুরি। তীব্র মতপার্থক্য সত্ত্বেও কীভাবে অভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হয়, তা রাজনৈতিক দলসহ সব মহলকে উপলব্ধি করতে হবে। অন্যথায় বিভেদ ও বিভ্রান্তির ফলে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও আধিপত্যবাদী ভারত সুবিধা পাবে, এমনকি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সম্ভাব্য অর্জনগুলোকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। দেশবাসীকে এ ব্যাপারে সচেতন ও জাগ্রত থাকতে হবে। দেশের মানুষ গত সাড়ে ১৫ বছরে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার অর্থাৎ শেখ হাসিনা নিজে ক্ষমতায় থাকতে পরিস্থিতি বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে কখনো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়, কখনো সূক্ষ্ম কারচুপি, আবার কখনো দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় টিকেছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেই ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ। এই অবস্থায় দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে স্বপ্ন বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে করে নির্বাচন বোধ করি ঝুলে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকারের দিকে চলে যাব। রাজনৈতিক সরকার ছাড়া বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যান্য দেশের সঙ্গে স¤পর্ক-কূটনীতি- সবকিছু আটকে থাকবে। আমরা আশা করেছিলাম, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সংস্কার হবে। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো করার পর একটা নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকারের দিকে দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো দেখছি কোনোরকম ঐকমত্য নেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। অন্যদিকে সরকারও ঢিলেঢালা কাজ করছে, ঠিকমতো রোডম্যাপ দিচ্ছে না। একেক উপদেষ্টা একেক কথা বলছেন। তিনি বলেন, ঐকমত্য না হলে, সংস্কার না হলে কী নির্বাচন হবে? ইসির পুনর্গঠন চেয়েছে এনসিপি। তাদের তো কোনো রেজিস্ট্রেশনই নেই। তারা কিসের আন্দোলন করে? সরকার তাদের কথা শুনছে সেটা আমরা দেখছি। এটা একটা কিংস পার্টি। এটা ছাত্রদের ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা এত বড় উদীয়মান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল, তাদের নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকবে, নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করবে, তৃণমূলে যাবে। এসব না করে কিংস পার্টি হয়ে সরকারের কাছে একটা করে আবদার নিয়ে যাচ্ছে আর সরকার মেনে নিচ্ছে। এভাবে কোনো রাজনৈতিক দল দাঁড়াতে পারে না। আমি জানি না, কে তাদের উপদেশ দিচ্ছে। টালমাটাল অবস্থা। নির্বাচন ঝুলে গেছে। দেশ এখন অত্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। কী হবে বলা সম্ভব না।
শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, সীমান্তজুড়ে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পুশইন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়াসহ নানা ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো বাড়ছে। যেমন- রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ এগোচ্ছে না, করিডর ইস্যু আছে, ভারতের নাগরিকের পুশইনের ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ নানান দিকে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায় কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা প্রধান উপদেষ্টা ভালো বলতে পারবেন।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নানা মহলে নানা শঙ্কা কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতি সচল রাখার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই আসবে না বলে আমি মনে করি। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি তাতে অর্থনীতির আকাশে ঘন কালো মেঘ ধেয়ে আসছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যেখানে ঘর থেকে শঙ্কামুক্ত হয়ে বের হওয়া যায় না, সেখানে অর্থনীতি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না। এজন্য সবার আগে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেখানে মানবিক বিবেচনায় করিডর দেওয়ার কথা, সেখানে তো কোনো কথা থাকে না। এর বাইরে চুক্তির বিষয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে সরকার বলছে, কোনো চুক্তি হয়নি। এটাকে পুঁজি করে কোনো কোনো দল রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দায়িত্ব কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোরই। তারা আন্তরিক হলে অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানবিক বিবেচনায় বিগত সরকার তাদের জায়গা দিয়েছে। এ বিষয়ে কিইবা বলার আছে? তিনি বলেন, কোনো না কোনো দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ ব্যক্তি পর্যায়ে যেসব আন্দোলন হচ্ছে, এটা দেশের জন্য ভালো না। সবার দাবি, চাওয়া-পাওয়া একই সময়ে দাঁড়িয়েছে। এমন এমন দাবি নিয়ে মানুষ রাস্তা, মহাসড়ক বন্ধ করে দিচ্ছে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো সামাল দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
দেশের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সীমান্তসহ সার্বিক পরিস্থিতির মাঝে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, সরকার তার নীতিতে অটল থাকতে পারবে না। স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনকে অবৈধ বলে আবার চট্টগ্রামের মেয়র নিয়োগ দেওয়া হলো। ঢাকার মেয়র নিয়ে একটি হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে। আপনি যদি সিদ্ধান্তই নেন যে তাকে মেয়রের চেয়ারে বসতে দেবেন না, তাহলে গেজেট করতে গেলেন কেন? এখন সাধারণ মানুষের মাথা খারাপ অবস্থা। মানুষের মধ্যে ভালো বার্তা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে। করিডর ও বন্দরের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তাদের মাথা না ঘামালেই ভালো হতো। তারা ন্যূনতম সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারলে সেটা দেশের স্বার্থে ভালো হবে। তিনি আরও বলেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরকারের বৈঠকের পর বৈঠক হচ্ছে। সরকার কী করতে চাচ্ছে সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার নয়। এখন মানুষকে আস্থায় ফেরাতে হবে। নির্বাচনসহ সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মকা-ের স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করে দিলে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরতে পারে বলে মনে করেন তিনি। -আমাদের সময়
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ