সুনামগঞ্জ , বুধবার, ২১ মে ২০২৫ , ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ ২০২৫ নিয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ জল জমি ধান মাছের ব্যাপক ক্ষতি হুমকিতে প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভোটের দিনক্ষণ আদায়ের ছক কষছে বিএনপি পাসপোর্ট, ভূমি, পাউবো, বিআরটিএসহ ২৫ প্রতিষ্ঠানের ৫৫ দুর্নীতির অভিযোগ যারা ঘুষ খায়, তারা অমানুষ : দুদক কমিশনার হাফিজ আহসান ফরিদ পথে যেতে যেতে: পথচারী শাল্লার পিআইও নুরুন নবীকে বরখাস্তের সুপারিশ বিশ্বরেকর্ড গড়ে এভারেস্ট জয় করলেন শাকিল ক্ষমা না চাইলে হাসনাতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা বিএনপির আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই : ইসি মাছউদ শাল্লায় পাউবো’র দখলে খেলার মাঠ! চেলা নদীতে ভেসে উঠলো নিখোঁজ শ্রমিকের লাশ ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে দিরাইয়ে বিক্ষোভ মাদক ব্যবসায়ীদের হামলায় সাংবাদিক কামাল আহত নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরেই, তবে জুনের পর নয় : প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ইজিবাইক চালকের মৃত্যু জামালগঞ্জে দুই শিক্ষিকাকে বিদায় সংবর্ধনা স্কুলছাত্রীকে অপহরণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন স্বপ্নের সেতু আশ্বাসেই বন্দী বজ্রপাতে দুই শ্রমিক নিহত
ফলন বাড়াতে মাত্রাতিরিক্ত সার-কীটনাশক

জল জমি ধান মাছের ব্যাপক ক্ষতি হুমকিতে প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

  • আপলোড সময় : ২১-০৫-২০২৫ ০৯:০১:৩৬ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২১-০৫-২০২৫ ০৯:০১:৩৬ পূর্বাহ্ন
জল জমি ধান মাছের ব্যাপক ক্ষতি হুমকিতে প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
বিশেষ প্রতিনিধি :: সুনামগঞ্জের হাওরে সবেমাত্র শেষ হয়েছে বোরো ফসল ঘরে তোলার কাজ। ধীরে ধীরে হাওরে পানি আসতে শুরু করেছে। এ বছর অনেকটা শঙ্কামুক্ত পরিবেশে ফলন ঘরে তুলেছে কৃষক। ওই চাষাবাদে প্রতি বছর হাড়খাটুনি পরিশ্রমের সাথে অন্যান্য খরচাপাতিসহ সার-কীটনাশক বাবদ মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হয় কৃষকের। এতে ভালো ফলন হয় এবং হাওরাঞ্চলের মানুষের মাঝে তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে। কিন্তু উচ্চ ফলনের আশায় অতি মাত্রায় সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে গোটা হাওরাঞ্চলকে কতখানি ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে সেই চিন্তা নেই কারও। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাওর সচেতন মানুষসহ মৎস্য, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। অনেকের সাথে কথা বলে জানাযায়, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করায় অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়ছে হাওরের প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশ। অতিমাত্রার এই প্রয়োগ হাওরের জল-জমিসহ উৎপাদিত খাদ্যশস্যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এতে প্রতি বছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও মাছের বংশ বিস্তার ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তার সাথে শামুক-ঝিনুকসহ অনেক জলজ প্রজাতিই হারিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, সার-কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে বাস্তুতন্ত্র যেমন বিনষ্ট হচ্ছে তেমনি জীববৈচিত্র্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া ক্ষেত-খামারে উৎপাদিত ওই কৃষিজ খাদ্য খেয়ে মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এক্ষেত্রে বিষমুক্ত বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন জরুরি বলে জানিয়েছেন অনেকে। পাশাপাশি জমিতে পরিমিত সার প্রয়োগসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ব্যবহার না করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শও বিশেষজ্ঞদের। হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অগ্রহায়ণের শুরু থেকে বোরো ও সবজি আবাদের মাসচারেক সময়কালে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় জমিনে। এর ক্ষতিকারক দিক হেমন্ত-বর্ষা দুই মৌসুমকেই নানাভাবে প্রভাবিত করছে। একটা সময় ধানী জমিতে ঘাসফড়িং ও পোকামাকড়ের বেশ উড়াউড়ি ছিল। যা ফসলের ভালো-মন্দ উভয় ক্ষেত্রে তার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে কাজ করেছে। ফসলের ক্ষতি করে এমন অনেক পোকামাকড় পাখিরা খেয়ে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষায় যা জরুরি। কিন্তু উচ্চ ফলনের আশায় ব্যবহৃত প্রতিষেধক কীটপতঙ্গ ও উপকারী অণুজীব সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেই সাথে খাদ্য সঙ্কটসহ নেতিবাচক নানা প্রতিক্রিয়ায় পরিচিত অনেক পাখি প্রকৃতি থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রিফিট, সার, কীটনাশকের রাসায়নিক মাত্রা মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের সৃষ্টি করছে। এর ফলে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। মাটির জীবনী শক্তি নষ্ট হচ্ছে। বর্ষায় হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর রাসায়নিকের অতিমাত্রা পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে জলজ বাস্তুতন্ত্র মারাত্বকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। যে কারণে দিন দিন দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবিস্তার এবং জলজ প্রাণী ও বিভিন্ন উদ্ভিদ আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে। বিষময় এই প্রতিক্রিয়া শুধু মাটি কিংবা পানিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। সার, রিফিট ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের ফলে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালমুখী দৌড়াচ্ছে। সার-কীটনাশকে ক্ষতি হয় ব্যাপক, তবু না দিয়ে উপায় নেই জানিয়ে জামালগঞ্জের হালি হাওর পারের হাওড়িয়া আলীপুর গ্রামের কৃষক মো. আয়না মিয়া জানিয়েছেন, এ বছর তিনি প্রায় ৫০ একরেরও (১০০ শতকে এক একর) বেশি জমি চাষাবাদ করেছেন। ধান পেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার মণ। এ জমি চাষ করতে প্রায় ২০০ বস্তা (লাল, সাদা, মাটিয়া) সার ব্যবহার করেছেন তিনি। যার বাজার মূল্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া ধানক্ষেত আগাছামুক্ত রাখতে রিফিটও ব্যবহার করা হয়েছে তার জমিনে। হাওরের প্রত্যেক জমিনে এই ব্যবহারের মাত্রা প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে পরিবেশ কর্মী গোলাম সারোয়ার লিটন বলেন, একসময় হাওরে চাষাবাদ ছিল প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে। বর্তমানে ঠিক তার উল্টো। এখন শতভাগ জমিতে হাইব্রিড-উফশী জাতের ধান চাষ হয়। ফলন বাড়াতে কৃষক রিফিট, সার, বিষ ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এর ফলে মাছসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হচ্ছে। কৃষক পরিবারে কিডনি, লিভার, ক্যানসারসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, রিফিট, সার, কীটনাশকে মাটি ও পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে হাওরের জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ায় খাদ্যের অভাবে পাখপাখালিও কমে যাচ্ছে। হাওরবাসীর জীবন-জীবিকাও হুমকিতে পড়ছে। সার-কীটনাশক ছাড়াও নানা কারণে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে জানিয়ে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, আমাদের খাদ্য-খোড়াকের অন্যতম যোগান হচ্ছে ধান ও মাছ। আমরা ধানের উৎপাদন বাড়াতে মাছের দীর্ঘ ক্ষতি ডেকে আনছি। হাওরই হচ্ছে ধান-মাছ উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র। কিন্তু আমাদের বাড়তি ফলনের আকাক্সক্ষা হাওরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সার-কীটনাশকের বহু ব্যবহার সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে হাওরের। এতে স্থল ও জলজ বাস্তুতন্ত্র, প্রকৃতি-পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিমিত সার-কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদন কীভাবে ঠিক রাখা যায়, সে ব্যাপারে কৃষকদের পরামর্শ দিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজনকে ভূমিকা রাখতে হবে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য জীববিদ্যা ও কৌলিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় বলেন, সার-কীটনাশক স্বল্প মাত্রায় ব্যবহার হলে তার প্রভাব তেমনটা পড়ে না। তবে বেশি মাত্রায় ব্যবহার হলে মাটি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য সব ক্ষেত্রে বিরুপ প্রভাব পড়ে। সারের ক্ষেত্রে তেমনটা না হলেও কীটনাশকের ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রাটা বহুগুণ বেশি। তিনি বলেন, ধান কাটার পর বৃষ্টিপাত হলে তার বিষক্রিয়া পানিতে গিয়ে মিশে। যা ফিশারিজের (মাছের) ক্ষেত্রে মারাত্বক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর নেতিবাচক প্রভাব মাছ থেকে মানবদেহে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের সৃষ্টির পাশাপাশি বহুমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শুধু সার-কীটনাশকের ফলেই যে হাওরের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়। হাওরের পরিবেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সার-কীটনাশকের অত্রিমাত্রা একটি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কৃষকরা অতিমাত্রায় যেভাবে সার-কীটনাশক ব্যবহার করছেন, পরবর্তীতে সেই মাত্রা আর কাজ করছে না। পরের বছর কৃষক বোঝে না বোঝে ব্যবহারের মাত্রা আর বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিটা জিনিসেরই একটা অপটিমাল ডোজ (নির্দিষ্ট পরিমাণ) আছে। এই ডোজ যখন ওভার ডোজে পরিণত হবে তখন সয়েল ফার্টিলিটি তো (মাটির উর্বরাশক্তি) নষ্ট হবেই। মৎস্য জীববিদ্যা ও কৌলিতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নির্ভর করে ওখানকার ইকোলজিক্যাল অ্যানভায়রনমেন্ট (বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ) কতটুকু ভালো থাকবে, কতটুকু খারাপ থাকবে। অনেক কারণেই আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এক্ষেত্রে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আবহাওয়া জলবায়ুর উপর প্রভাব পড়তেই পারে। এ ব্যাপারে মৎস্য ও কৃষি অধিদপ্তর কর্তৃক কৃষকদের সচেতনতার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, মৎস্য ও কৃষি অধিদপ্তরের নিজস্ব লোকবল আছে। ওভার ডোজ ফার্টিলাইজার (বেশি পরিমাণে সার-কীটনাশক) যেন কৃষকরা পরিহার করে। বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে কী ক্ষতি হতে পারে সে ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ক্যামিকেল তো ক্যামিকেলই। এটার বেড ইফেক্ট (খারাপ প্রতিক্রিয়া) তো থাকবেই। কেউ মাত্রাতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহার করলে স্বাভাবিকভাবে সবকিছুরই ক্ষতি হবে। তবে এখানকার জমিতে তুলনামূলক কম সার-কীটনাশকই ব্যবহার হয়। এখানকার হাওরগুলো মূলত একফসলী। ওই এলাকার মাটি ন্যাচারালি (প্রকৃতিগত) উর্বর থাকে। এখানে সার কিংবা কীটনাশকের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। তিনি জানিয়েছেন, এ বছর সুনামগঞ্জে হাওর-নন হাওর মিলে ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদন হয়েছে ১৩ লক্ষ ৯৬ হাজার ৮০ মেট্রিক টন ধান। এই উৎপাদনের বিপরীতে জেলা কৃষি অধিদপ্তর ৮ হাজার ৫০০ জন কৃষকের মাঝে প্রণোদনার সার বিতরণ করেছে। প্রতিজনকে ডিএপি ১০ কেজি (মাটিয়া) ও এমওপি ১০ কেজি (লাল) করে সার দিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর। পরিমিত সার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহারে মাটি, পানি, জমি, ফসল, প্রকৃতি-পরিবেশ সবকিছুর উপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই মাত্রানুযায়ী সার ব্যবহার করতে হবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স