মোহাম্মদ আব্দুল হক::
শুরুতে লিখছি, সুফী ও সুফীবাদ হলো এক বিশাল জ্ঞানের জগৎ। এ জগতে শত শত বছর ধরে মহামনীষীগণ বিচরণ করেছেন এবং যুগে যুগে আরও আরও জ্ঞানী দার্শনিকগণ বহু বর্ণনায় লিখে গেছেন।
আমি পড়ি এবং খুঁজে পাই আবার ধ্যানমগ্ন হই। সেখান থেকেই সুফী ও সুফীবাদের বিষয় নিয়ে এই খুবই সংক্ষিপ্ত লেখা। যখন ¯œাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলাম তিনশো নম্বরের দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়েছি। সেই থেকে সুফীবাদ নিয়ে অল্প কিছু ধারণা পেয়েছি এবং এরপর যখনই মনে হয়েছে বা প্রসঙ্গ সামনে এসেছে তখনই সুফীবাদের স্বরূপ খুঁজে খুঁজে অনেক দার্শনিকের লেখা পাঠে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করেছি। চিন্তা করে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি। এ এমন এক জ্ঞান যা ব্যক্তিমানুষ গভীর ধ্যানমগ্নতা থেকে অর্জন করে। গভীর জ্ঞানে দীক্ষিত মানুষ ছাড়া অন্যদের সাথে এ জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেও খুব একটা ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ জন্যেই বলতে হয়, সুফীবাদ হলো জ্ঞানের এক উঁচু স্তর যা হালকা পাঠাভ্যাসের মানুষের পক্ষে ধারণ করাও সহজতর নয়।
সুফী ও সুফীবাদের বিষয় নিয়ে আলোচনায় মনে রাখতে হয়, এ বিষয়টি তাদের পক্ষে বুঝা সহজ যাদের আল্লাহ প্রেম, আল্লাহ ভীতি, সৃষ্টি জগত ও আল্লাহ তায়ালায় ধ্যান আছে। আমার মনে হয়, যারা চিন্তাশীল ও জ্ঞান চর্চায় মনোযোগী, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানকারী এবং আল্লাহর প্রতি প্রেম ও আল্লাহ ভীতি আছে যাদের তাদের জন্য অবশ্যই সুফীবাদের জ্ঞান চর্চা খুবই অর্থবহ হবে এবং তা প্রয়োজনীয়।
সুফীবাদ হচ্ছে একটি বিশেষ মরমী বা গুংঃরপ ভাবধারা। যদিও অনেক গান শোনা ও কবিতা পাঠের পরে অনেকের কাছে সুফী ও মরমী কাছাকাছি উচ্চারিত হয়, তারপরও সুফী ও মরমী শব্দ দুটি সম্পূর্ণ সমার্থক মনে করলে ভুল করা হবে। কারণ, সুফী শব্দের সাথে ঐশী ধর্মীয় জ্ঞান ও ভাবগাম্ভীর্যের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কাজেই শুধু মরমের উপলব্ধি থেকে উৎসারিত কথা সম্বলিত মরমীবাদকেই সুফীবাদের সাথে মিলিয়ে বুঝাতে চাইলে সঠিক বুঝায় না, বরং তা হতে হবে ইসলাম ধর্মের এবং আল্লাহ প্রেমের ভিত্তিতে।
সুফী ও সুফীবাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু শত বছর ধরে অনেকে আবির্ভূত হলেও সুফী ও সুফীবাদ নাম পরবর্তীতে এসেছে। পরবর্তীতে ইউরোপ মহাদেশীয় বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত ‘মিস্টিক’ শব্দটিই আরবি, ফারসি ও তুর্কী মুসলমানদের প্রধান ভাষায় ‘সুফী’ নামে বহুল পরিচিত হয়েছে। ‘সুফী’ আরবি শব্দ ‘সুফ’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সুফী কে বা কারা? এখানে সুফী বলতে এমন ধরনের ব্যক্তিকেই বুঝায় যিনি পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সকল বিষয় পরিহার করে চলেন এবং দুনিয়ায় শক্তি ও সম্পদের দম্ভ করেন না বা ধনসম্পদের গর্ব পরিত্যাগ করে চলেন এবং দুনিয়াতে খুবই সাধারণ পোশাক পরিধান করে সাধারণ মানুষের ন্যায় জীবনযাপন করেন।
সুফীগণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে। সুফীগণ নিজেদের মধ্যে ভিতরে বাহিরে পবিত্র চরিত্র ধারণ করেন এবং তারা চিন্তা, কথা ও কাজে অন্তরের পবিত্রতার উপর খুব বেশি মনোযোগী থাকেন। এ বিষয়টি এ-যুগে সম্পূর্ণ নতুন কোনো বিষয় নয়, বরং এটি সব সময়-ই এবং সব সমাজে-ই কোনো কোনো মানুষের মধ্যে কোনো-না-কোনো রূপে এসেছিলো এবং এসে যায়।
সুফীবাদ হচ্ছে ইসলামি শিক্ষার এমন এক বিশেষ দিক যার আলোচনায় পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ভক্তি, পারলৌকিকতা ও বৈরাগ্যবাদ নিয়ে বেশি জোর লক্ষণীয়। কোনো কোনো মানুষের মনে আল্লাহ ভীতি ক্রমশ এমন বদ্ধমূল হয়ে উঠে তখন ওই ধরনের মানুষ পর্যায়ক্রমিক ঐশীবানীর প্রভাবে আত্ম অনুশীলন করে, ধ্যান ও শৃঙ্খলা চর্চার মাধ্যমে দিনে দিনে আরও গভীর ঐশী প্রেমে মজে যায়।
এখানে ইহকালীন ভোগবাদী জীবনের জ্ঞান প্রাধান্য পায় না। এ বিষয়ক জ্ঞান সহজে কাউকে দেওয়াও যায় না আবার এ সম্পর্কিত জ্ঞান চাইলেই সহজে পাওয়া যায় না। এ জন্য ধারাবাহিক জ্ঞান চর্চা করতে হয় এবং স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টিতে ধ্যানী হতে হয়। এ জ্ঞান চেষ্টা করে অন্য কারো অন্তরে বা মগজে প্রবেশ করানো যায় না। সুফী ও সুফীবাদ বিষয়ক জ্ঞান এক জ্ঞানী ও ধ্যানী রিদয় ও মস্তিষ্ক থেকে অন্য জ্ঞানী ও ধ্যানমগ্ন রিদয়ে ও মস্তিষ্কে যোগাযোগ রক্ষা করে এগিয়ে যায়।
এখান অনেকে আছেন যারা লম্বা সাদা দাড়ি ও সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা দরবেশী বেশভূষার লোককে ‘সুফী’ অথবা কখনও কখনও এদেরকে ‘সুফীসাব’ বলে থাকেন আবার কেউ কেউ ফকিরি বেশভূষা নিয়ে চলা অনেকটা উদাসীন লোককে ‘সুফী’ মনে করে ভুল করেন।
এ-সব বাহ্যিক আবরণের ভিত্তিতে রঙতামাশা করে ‘সুফী’ ও ‘ফকির’ পরিচয়ে কাউকে সমাজে তুলে ধরা কোনোভাবেই উত্তম কাজ হতে পারে না। এতে করে সুফী শব্দের অপব্যবহার বেড়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে একজন আসল সুফীকে কোনোভাবেই একজন ফকির বা একজন দরবেশ মনে করলে ভুল করা হবে। ফকির ও সুফীর মধ্যে পার্থক্য আছে এবং সেটা বাহ্যিক পোশাক দেখে বুঝতে চেষ্টা করলে ভুল হবে। সুফী ও সুফীবাদের ধারণা বিশাল জ্ঞান নির্ভর। এসব কখনও কাউকে সহজে বুঝানোর বিষয় নয়।
এ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে সুফী ও সুফীবাদ প্রসঙ্গে মোটামুটি একটা বিষয় আশা করছি উপস্থাপন করতে পেরেছি যে, এ বিষয়ের সাথে আল্লাহ প্রেম ও গভীর জ্ঞান সম্পর্কিত। বুঝতে হবে, সুফী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি পাকাপোক্ত বা পরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ প্রেমিক উচ্চমানের শিক্ষায় শিক্ষিত। ফকির হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ যার আচরণে জ্ঞান খুঁজে পাওয়া যায় না, অনেকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের এবং বিদ্যাবুদ্ধিও খুব বেশি নাই।
এ সম্পর্কিত ইতিহাস বহু শতাব্দীর দীর্ঘ পথের। সুফীবাদের ইতিহাসের দুটি পর্যায়ের প্রথম পর্ব মুসলিম যুগের কয়েক শতক নিয়ে। মুসলিম যুগের প্রথম তিন শতকের সুফীদের বৈশিষ্ট্য ছিল মানবীয় উচ্চাশা পরিত্যাগ ও আল্লাহ প্রেমে নিবেদিত জীবন নির্বাচন। যুগে যুগে বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে আরও জানা যায় পরবর্তীতে সুফীবাদ একটি বহু চেহারার বিষয় হয়েছে এবং সেজন্যে বিভিন্ন সুফী’র বর্ণনা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
প্রথম দিকে ধর্ম বিশ্বাস ও জ্ঞান অনুশীলনের বিবেচনায় সুফীগণ ছিলেন রক্ষণশীল মুসলমান যাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যে পাওয়া গেছে ত্যাগ, সংযম, স্রষ্টায় ভয় এবং পার্থিব জীবনের রঙতামাশা বিমুখ। সুফীবাদ বিষয়ক পাঠান্তে প্রথম যুগের সুফীদের মধ্যে পাওয়া যায় আবু হাসেম, রাবেয়া বসরী, জুন্নুন মিসরি, বায়েজীদ বুস্তামী, জুনায়িদ বাগদাদী প্রমুখ বিশিষ্টজনের নাম। পরবর্তী পর্যায়ে বহু রকম বায্যিক প্রভাবে সুফীবাদের প্রথম দিকের বিশেষ বৈরাগ্যবাদী ভাবধারা সর্বেশ্বরবাদী মরমীবাদের দিকে যায়।
এখানে সুফীবাদের সঙ্গে বেশকিছু পরদেশীয় ও ইসলামের সাথে যায় না এমন অনেক সংস্কৃতি ও উপকরণ এসে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই পরবর্তী সময়ের বিশিষ্টজনের মধ্যে মনসুর হাল্লাজ, ইবনুল আরাবী, রুমী, জামী প্রমুখের নাম বিভিন্ন আলোচনায় পাওয়া যায়। তার-ও অনেক পরে আল গাজালীর মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনাচারে সুফীবাদ এক স্বীকৃত অবস্থায় পৌঁছে। পরিশেষে বলছি, সুফী ও সুফীবাদের আলোচনায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও থামা সহজ হয় না। তারপরও সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদেরকে থামতে হয়। সুফী ও সুফীবাদ নিয়ে জ্ঞান চর্চা অব্যাহত রাখার পণ করে এ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা এ পর্যন্ত শেষ করলাম।
লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha