সুনামগঞ্জ , সোমবার, ০২ জুন ২০২৫ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জমে উঠছে কোরবানির পশুর হাট নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে একসাথে কাজের আহ্বান শান্তিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, রোগীদের চরম ভোগান্তি বিশ্ব দুগ্ধ দিবস পালিত নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়ক সুনামগঞ্জে ২ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত নদ-নদীর পানি বাড়লেও হাওরে পানি কম বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত আন্তর্জাতিক গুম সপ্তাহ উপলক্ষে অধিকার’র মানববন্ধন ভাটির হাওরে ক্ষেতমজুররাই নব্য উৎপাদক শক্তি ডিজেলের দাম কমল লিটারে ২ টাকা, পেট্রল-অকটেনে ৩ টাকা দোয়ারায় বজ্রপাতে মারা গেলো তিন গরু রুট পাল্টে নৌপথে সক্রিয় চোরাকারবারিরা প্রশাসনের জব্দকৃত বালুভর্তি বাল্কহেড উধাও! তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় হাওরে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দাবি নারীনেত্রী দিপালী চক্রবর্তী’র ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মেঘালয়ে পরিবেশ বিনাশের দায় মেটাচ্ছে তাহিরপুর

  • আপলোড সময় : ২৫-০৪-২০২৫ ০৮:৩৮:২৪ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৫-০৪-২০২৫ ০৯:১০:১১ অপরাহ্ন
মেঘালয়ে পরিবেশ বিনাশের দায় মেটাচ্ছে তাহিরপুর
ঈশিতা দস্তিদার::
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা। 
মেঘ, পাহাড়, নীলাদ্রি লেক আর যাদুকাটা নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু অপরূপ তাহিরপুর যে ক্রমে ভয়াবহ দুর্দশা ও বিপর্যয়ে পড়ছে, সেটা বাকি বাংলাদেশের এখনই জানা দরকার। শুধু প্রকৃতি নয়; প্রকৃত তাহিরপুরকে জানতে-বুঝতে সম্প্রতি উপজেলার একেবারে সীমান্ত এলাকার দিকে গিয়েছিলাম।

চানপুর, রজনীলাইন, পাহাড়তলী, আমতৈল, শান্তিপুর, রাজাই, কড়ইগড়াসহ কমবেশি বিশটি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের বাস এখানে।
হাজং, মান্দি, খাসি, বাঙালিসহ বহু উদ্বাস্তু ও স্থানান্তরিত মানুষও আছেন। মেঘালয়ের কয়লা খনি, বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, পরিবেশ বিপর্যয়, পাহাড় ধসে বালু-পাথরের বন্যায় আবাদি জমির ক্ষতি, কর্মহীনতা, যাদুকাটা-রক্তি নদী ঘিরে কয়লা-পাথর বাণিজ্য, কাঁটাতারের বেড়া, অসহায় মানুষের স্থানান্তর ও ভূরাজনীতি মিলে এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

নদী বেয়ে বিপর্যয়ের স্রোত : ভারত থেকে প্রবাহিত ২২টি নদী ও সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়াগুলোর জলধারা হাওরাঞ্চলের পানির উৎস। একসময় বৃষ্টির ঢল নেমে হাওর এলাকায় সৃষ্টি হতো মৌসুমী বন্যা। ঢল ও বন্যার পানি কবে কোন নদী দিয়ে কোন হাওরে নামবে, তার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা এ অঞ্চলের মানুষের সহজাতভাবে জানা ছিল।
বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মেঘালয় রাজ্যে পাথর ও কয়লা খনন, প্রাকৃতিক বনভূমি বিনষ্ট করে অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির জন্য প্রায়ই ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা ও ঢলের সঙ্গে ধসের পাথর ও বালুতে ঢেকে যাচ্ছে সীমান্তের এদিকের ফসলি জমি, বসত ভিটা ও পানির উৎস প্রাকৃতিক ছড়া।

তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অনেক এলাকা ইতোমধ্যে পাহাড়ি বালুতে ঢেকে গেছে। তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী কড়ইগড়া থেকে ধীরেন্দ্রনগর প্রায় অর্ধশত গ্রাম এক অর্থে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই কৃষিজীবন থেকে উচ্ছেদ হয়ে দিনমজুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মেঘালয় পাহাড়ের বালু ও পাথরের ঢলে পরিবর্তিত হচ্ছে জলপথগুলোর ঐতিহাসিক গতিপ্রকৃতি, যা আবার এতদিনের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর শুরু অনেক বছর আগে।

২০০৮ সালের ২০ জুলাই টানা পাঁচ দিনের বৃষ্টিতে ধসে পড়ে মেঘালয়ের কালাপাহাড়ের অনেকখানি। এতে তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের চানপুর-রজনীলাইন-পাহাড়তলীর প্রায় ৫০০ একর রোয়া জমি ৪-৫ ফুট বালু-পাথরের নিচে তলিয়ে যায়। প্রায় ৩০০ ঘর, ২টি বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা, ১টি বাজার, ৪টি মসজিদ, চানপুর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ অবস্থা রুখতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। ইতোমধ্যে আক্রান্ত গ্রামগুলোর অনেক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে গেছে শহরে ও বিভিন্ন জেলায়।
বিপদের নানা দিক : মেঘালয়ের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পাহাড়ে রয়েছে কয়লা ও চুনাপাথরের অনেক কোয়ারি। এগুলোর খননকৃত মাটি ও বালু ১৮টি ছড়া দিয়ে নেমে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বর্তমান লেখক স্বচক্ষে চুনাপাথর, বালু, কয়লার কারবার দেখে এসেছেন। স্থানীয় জনসাধারণের ভাষ্যমতে, ২০০৭ সালে বর্ষা মৌসুমে প্রথম বালু ও পাথরের বড় ঢল নামে।

২০০৮ সালে মহাবিপর্যয়ের দিনে এক রাতের মধ্যে সশব্দে পাহাড় ধসে ‘একতলা বাড়িসমান’ পাথর ও বালু তাহিরপুর এলাকার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে। কয়েক হাজার হেক্টর আয়তনের ছোট-বড় ২০টি হাওর বালুর স্তরে চাপা পড়ে। এর পর থেকে প্রতিবছর বন্যা ও ঢলের সঙ্গে বালু ও পাথরখ- নেমে আসছে। বছরে তিন-চারবার ভিটে উঁচু করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। পাশাপাশি বিরান হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি। বেড়ে চলেছে কর্মহীনতা। স্থানান্তরিত হচ্ছে বিপুল জনশক্তি। মেঘালয়ের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পাহাড় ফাঁপা করে তৈরি হয়েছে আলোচিত খনিগুলো। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।
এসব পাহাড়ের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করছে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা এবং হাওর এলাকার প্রাণ-প্রকৃতি। স্থানীয় আদিবাসী মান্দি, হাজং, খাসি ও দরিদ্র উদ্বাস্তু বাঙালিদের প্রধান জীবিকা ছিল পাহাড়-জলাভূমিনির্ভর। কিন্তু বর্তমানে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়লা ও পাথর খনিতে কাজ করেন। খনিতে কাজ করতে গিয়ে অপমৃত্যুর শিকার হন অনেকে; অনেকে সন্তান হারিয়ে দিশেহারা।

কোনো পরিবারে একই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন দুই সহোদর। সীমান্তের কাঁটাতারের ফাঁক গলে সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে বিপন্ন ও বেপরোয়া মানুষ ভোরের আলো ফোটার আগেই কয়লা খনিতে নামেন। কখনও খনির ভেতর জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসে বা পাথরচাপায় প্রাণ হারান।

স্থানীয় অধিবাসী ও কয়লা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে রোজার ঈদের সময় অনেক মানুষ খনিতে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন। দুর্ভাগ্য, এসব মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
রাষ্ট্রের করণীয় : সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলার এ সমস্যা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে।
এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বিএসএফকে চিঠিও দিয়েছিল তৎকালীন বিডিআর। স্থানীয় সংগঠন ‘উইকক্লিব সিম যুব সংঘ’ এবং এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

২০০৯ সালে আবাদি জমি বিনষ্ট ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনকে বিষয়টা অবহিত করে। পাশাপাশি এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তাহিরপুরে দুর্দশা তাতে কমেনি। উজানের পাহাড়ধস ও বালু-পাথরের কবল থেকে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো বাংলাদেশের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে মেঘালয়ে অন্যায্য ও অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা ও থামানো দরকার। পাশাপাশি তাহিরপুরের মতো এলাকাগুলোতে জীবনের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতকে সম্মিলিতভাবে বিদ্যমান আইনি কাঠামো অনুসরণ করে, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে, পরিবেশ ও জনগণের সংকট ও চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। নিশ্চয়ই সেটা সম্ভব।

[সংকলিত] ড. ঈশিতা দস্তিদার: নৃবিজ্ঞানী; বৃহত্তর সিলেটের খাসি সমাজ গবেষক

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স