মো. আবুসালেহ সেকেন্দার::
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের অভিযোগ- জুলাইয়ের অভ্যুত্থানকারীরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতীয় মিডিয়ায় অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্রমাগতভাবে ‘দখলদার’ বলে দাবি করছেন।
যারা এসব বলছেন, তাদের মতে, ৫ আগস্ট একাত্তরে পরাজিত একটি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে। যদিও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার দাবি ভিন্ন। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন, তাদের দাবি হলো যে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা শ্রদ্ধা করেন এবং একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেই তারা সামনে এগিয়ে যেতে যান। গণ-অভ্যুত্থানের ফসল জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারাও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে চান বলে দাবি করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে অন্য প্রধান অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতারাও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার কথা বারবার বলছেন। তাদের অনেক নেতা দাবি করছেন যে, স্বাধীনতা বিরোধী একটি চক্র জুলাইয়ের নামে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা জামায়াতে ইসলামীও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা বয়ান তৈরি করে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করতে মরিয়া লড়াই করছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হওয়া নিয়ে জুলাইয়ের বিপ্লবীদের মধ্যে ওই লড়াই আমাদের আশ্বান্বিত করে। এতদিন মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ তাদের একক কর্তৃত্বে রেখেছিল বলে তার বিরোধী পক্ষ যে প্রচারণা চালিয়েছে তার অবসান হওয়ার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিচরণকারী সবপক্ষই যদি মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে এবং নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রমাণে সদা তৎপর থাকে তাহলে আমরা দীর্ঘদিন যে দাবি করছিলাম তা পূরণের পথ কি তবে জুলাই তৈরি করেছে? আমাদের দাবি ছিল- বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দল উভয়কে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে তা সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের সবপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজেদের সরব অবস্থান তুলে ধরায় ওই পথই প্রশস্ত হচ্ছে। কিন্তু তর্কের মাঠে ও বয়ান তৈরির কাগুজে আলাপের মধ্যে এক ধরনের ফাঁকফোকর লক্ষ করা যাচ্ছে। যদি জুলাইয়ের সবপক্ষই তাদের দাবি মতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয় তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার যে চেষ্টা হয়েছে তার দায় আসলে কার?
মুক্তিযুদ্ধ যদি তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে কেন জুলাইয়ের পক্ষ শক্তিরা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষা করতে পারলো না? ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি না হয় শেখ হাসিনার পিতার বাড়ি বলে ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিন্তু সেটি রক্ষায় তারা তো কোনো পদক্ষেপ নেননি।
জুলাইয়ের অভ্যুত্থানকারীদের অনেকের দৃষ্টিতে ৩২ নম্বর ছিল ‘ফ্যাসিবাদের ধর্মশালা’। তাই অন্যরা ৩২ নম্বর রক্ষায় এগিয়ে যায়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অন্য স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষা না করতে পারার ব্যর্থতার দায় কি তারা নেবেন নাকি এক্ষেত্রে তাদের প্রচ্ছন্ন মদদ ও মৌন সম্মতি রয়েছে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথের স্বার্থে উপযুক্ত প্রশ্নের উত্তর তাদের নিকট থেকে আমরা আশা করি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর আওয়ামী লীগের যতটা না পৈতৃক সম্পত্তি তারচেয়ে বেশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন। ধানমন্ডি ৩২-কে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা শুধু অসম্ভব নয় বরং অকল্পনীয় বটে। তারপরও রাজনৈতিক বিতর্ক এড়াতে আপাতত ৩২ নম্বরে আইএস-এ’র পতাকা উড়িয়ে ভাঙার ঘটনাকে একপাশে সরিয়ে রাখলাম। কিন্তু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের অন্য স্মৃতিচিহ্নগুলো গুড়িয়ে দেওয়া হলো কেন? তবে কি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অভিযোগ সত্য? তবে কি জুলাইয়ের অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে একটি পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আছে? এজন্যই তাদের মদদেই জুলাইয়ে মবতন্ত্রের আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে?
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক বাড়ি হলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর কোনও ব্যক্তির বা দলের সম্পত্তি নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্পত্তি। জাদুঘরে ইতিহাসের নামে অতিরঞ্জিত কিছু যদি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রদর্শিত হয়ে থাকে তা নিয়ে আলাপ করা যেত। বিতর্ক করা যেত। কিন্তু কোনোভাবে তা ভেঙে চুরে চুরমার করা মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষের আদর্শ হতে পারে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘরের মতো সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন জুলাইয়োত্তর বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে। ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা মুজিবনগরের মুক্তিযুদ্ধের নিরীহ ভাস্কর্যগুলোর কী অপরাধ ছিল যে তা জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের নামে গুড়িয়ে দেওয়া হলো? ওই জড় ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে ফ্যাসিবাদের কোনও সম্পর্ক নেই এটা স্পষ্ট। বরং তা ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী, গণতন্ত্রপন্থী মানুষের প্রতীক ও প্রেরণার উৎস। কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের নামে মুক্তির প্রতীক, স্বাধীনতার প্রতীক, গণতন্ত্রের প্রতীক ধ্বংস করা হয়েছে কার স্বার্থে সেই বিষয়ে এদেশের গণতন্ত্রপন্থী মানুষদের জানার অধিকার আছে।
মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর মতো একই পরিণতি না হলেও এই বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন লালমনিরহাটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, লালমনিরহাটের ওই দীর্ঘ ম্যুরালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, উদিত সূর্য, ৭১-এর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধা, পতাকা হাতে হাতে বিজয়ে উচ্ছ্বসিত জনতা, ৭ বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। ওই ম্যুরালের জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে যায় না দাবি করে ঢেকে রাখা এবং পরবর্তীকালে ভেঙে ফেলা হয়েছে তা স্পষ্টত স্বাধীনতাবিরোধী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রের কাজ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের জুলাইয়ের নামে ইতিহাসের এই সব নতুন ভ্রান্ত বয়ান নতুন ফ্যাসিবাদ তৈরির পথ তৈরি করছে।
তাই এদের থামানো দরকার এখনই। শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন নয়, জুলাইয়োত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের নামফলকও রক্ষা পাচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের নামফলক মুছে দেওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাইয়ের সবপক্ষ যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি হয় তাহলে এগুলো কারা করছে? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অযথা বিতর্কে না জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের ভিত্তি মেনে নিয়ে জুলাইয়ের হাত ধরে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়।
তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষা করা স্বাধীনতার পক্ষের, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, গণতন্ত্রের পক্ষের সবার দায়িত্ব। যারা ওই দায়িত্ব পালনে সম্মত নয় তারা আর যাই হোক স্বাধীনতার পক্ষের, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি হতে পারে না।
তাই জুলাইয়ের নামে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে কেউ যেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হবার প্রতিশোধ নেবার সুযোগ না পায় সেই দিকে সকলের নজর দেওয়া জরুরি।
[সংকলিত] লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, নেপাল নিউজ ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন কেন আক্রান্ত?
- আপলোড সময় : ২৪-০৪-২০২৫ ১০:৩৯:২৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-০৪-২০২৫ ১১:০৫:৩৫ অপরাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ