সুনামগঞ্জ , শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
সুরমার ভাঙনে বদলে যাচ্ছে ৩ গ্রামের মানচিত্র, ভাঙন রোধে নেই পদক্ষেপ ‘ডিসেম্বরই শেষ সময়’, আজ যুগপৎ সঙ্গীদের সঙ্গে বসছে বিএনপি ফসল তোলার উৎসব-সংগ্রামে একাকার হাওর-ভাটির কৃষক উৎকণ্ঠার মধ্যেই হাওরে ধান কাটার ধুম কোন কৃষককে হয়রানি করা যাবে না : খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিএনপি ও কৃষক দলের সংবাদ সম্মেলন বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অর্থায়নে বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালুর দাবিতে এবার শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ বেড়েছে অগ্নিকান্ডের ঘটনা, তিন মাসে জেলায় ৮৭ অগ্নিদুর্ঘটনা ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস, দুশ্চিন্তায় কৃষক জগন্নাথপুরে ভোক্তা অধিকার আইন বিষয়ক সভা ঢাকা ছাড়তে পুলিশের আবেদনের হিড়িক, ছয় মাসে সাড়ে সাত হাজারের বেশি বদলির আবেদন সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মী খুন সীমান্তে ভারতীয় ১২ গরু জব্দ হাসপাতাল চালুর দাবিতে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ হাওরে চড়ক উৎসবে মানুষের ঢল ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা, দ্রুত পাকা ধান কাটার আহ্বান
হাওরে ৮০ কিলোমিটার ঘুরুন্তি

ফসল তোলার উৎসব-সংগ্রামে একাকার হাওর-ভাটির কৃষক

  • আপলোড সময় : ১৮-০৪-২০২৫ ০১:৩০:১৩ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৮-০৪-২০২৫ ০১:৪৪:০৫ পূর্বাহ্ন
ফসল তোলার উৎসব-সংগ্রামে একাকার হাওর-ভাটির কৃষক
শামস শামীম::
ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জলাভূমি হাওরে বছরের প্রায় সাত মাস থইথই জল থাকে। বোরো ধান চাষাবাদের জন্য প্রায় ৫ মাস পানি থাকেনা, তবে একেবারে জলশূন্যও হয় না। হাওরের একমাত্র ফসল এই বোরো ধান এখন পাকতে শুরু করেছে। শনশন বাতাসে দোলছে ধানের শীষ। ধানের অপার্থিব এক বিশুদ্ধ গন্ধে মনমগজ দোলে। চোখ খুঁজে পায় স্বস্তির আরাম।
দেখা যায়, হাওরের কান্দায় চলছে খলাঘর তৈরি ও ধানখলা তৈরির ধুম। কোথাও কোথাও ধান কাটা হচ্ছে। চলছে মাড়াই ও শুকানো। কোথাও যন্ত্রে কোথাও শ্রমিকরা ধান কাটছেন। এদিকে হাওরের স্থানীয় বাজারগুলোতে বৈশাখের ফসল তোলার উৎসবে যুক্ত হতে কাস্তে, ধানবহনের ভার ও ছিক্কা বিক্রি হতে দেখা গেছে। ফসল উৎসবের এই উপকরণ কিনছেন কৃষকরা। বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ লাখ কৃষক এখন ফসল তোলার উৎসবে নানাভাবেই যোগ দিয়েছেন। হাওরে-কান্দায় তাদের স্ত্রী, কন্যা, শিশু কিশোর সন্তান সন্ততিদেরও নিয়ে এসেছেন।

সরেজমিন সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ ও জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ১৫ এপ্রিল জামালগঞ্জের দুর্গম পাগনার হাওরে গিয়ে দেখা যায়, হার্ভেস্টর যন্ত্রে ধান কাটা হচ্ছে। খলা তৈরি করছেন কিষাণীরা। যেখানে কিছু আগাম জাতের ধান কাটা হয়েছে তা মাড়াই ও শুকানো চলছে। কয়েকটি স্থানে দেখা গেল কাস্তে হাতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটা চলছে। কৃষকরা জানালেন আরো ১৫ দিন সময় পেলেই হাওরের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। পাগনার হাওরের ছয়হারা গ্রামের ভিতর দিয়ে ডুবন্ত ব্লকের সড়ক ধরে গঙ্গাধরপুর হয়ে কুজারগাঁও করচবাগান পর্যন্ত জাঙ্গালের দুই দিকেই দেখা যায় ফসল তোলার চিত্র। দীর্ঘ কান্দা জুড়ে ঘাসের বিস্তার। নয় মৌজার চারদিকে হাওর ও কানাইখালী নদীকে ঘিরে দেশের সর্ববৃহ কয়েকটি করচ বাগান তার ঘনসবুজের ঘোমটা খুলে রূপের বাহার দেখাচ্ছে। করচ বাগানের ছায়ায় শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়াচ্ছেন কৃষক। কয়েকদিন পরেই আরো উৎসবমুখর হবে হাওরপাড়ের পরিবেশ। দেখা গেল নারীরা ধানখলা গোবর দিয়ে লেপামোছা করে তৈরি করছেন। কোথাও কোদালে মাটি ছেদে খলা পরিষ্কার করছেন। এখান থেকে রাজারবাজ, গাজিপুর, ভান্ডা, মাখরখলা হয়ে ভীমখালি পর্যন্ত আসতে একই চিত্র দেখা যায়। কৃষকরা ঘর ছেড়ে সবাই হাওরে চলে এসেছেন ফসলের মায়ায়। হাওরের জাঙ্গাল কান্দা হয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এই যাত্রায় চলাচল সহজের জন্য তৈরি গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে নদী ও খাল খুন হয়ে যাওয়ার চিত্র লক্ষ করা গেছে। হাওরে জালের মতো বিস্তৃত খাল ও নদী মরে শুকিয়ে গেছে। এতে বর্ষার পানি ও বন্যার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে জানালেন অভিজ্ঞ কৃষকরা। খাল ও নদীকে হত্যা করায় হারিয়ে যাচ্ছে নাম। স্থানীয়রা পরে এটিকে ‘মরা খাল, মরা নদী’ হিসেবে ডাকছেন। এমন কয়েকটি মরা খাল ও নদীও দেখা হয়ে গেল এই দীর্ঘ ঘুরুন্তিতে। ভীমখালি থেকে মুক্তাখাই, ঢালা, তেরহাল, নোয়াখালি, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর, মদনপুর, নীলপুর, জানিগাঁও পর্যন্ত চিত্রও একই। সবখানেই হাওরের বোরো ফসল গোলায় তোলার উৎসবের অপেক্ষায় দেখা গেছে কৃষকদের।
বিভিন্ন স্থানে ফসল কাটার উৎসব শুরুও হয়ে গেছে। হাওরের ভিতরে যখন এই অবস্থা তখন ভীমখালী, নোয়াখালি ও নীলপুর বাজারে এসে দেখা যায় কাস্তে ও ভাঁর-বাঁশ ও বাঁশ বেতের তৈরি ছাতা বিক্রি হচ্ছে।
ধান শুকানোর জন্য একসময় বাঁশের তৈরি দাড়ি, ধান রাখার টাইল (ভাড়ার) বিক্রি হলেও এখন দেখা যায় প্লাস্টিকের ত্রিপাল বিক্রি হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে গৃহস্থালির বাঁশবেত পণ্য।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে বেরিয়ে আবার শহরে ফেরা পর্যন্ত হাওরের বুক চিরে দীর্ঘ এই ৮০ কিলোমিটারের যাত্রাপথে কথা হয় গ্রামের প্রবীণ ও নবীন কৃষকদের সাথে। তারা জানালেন, এবার হাওরের ফসল ভালো হয়েছে। বিআর ২৮-২৯ এর বদলে হাইব্রীড বা উফশী নানা প্রজাতির ধান ভালো ফলন হলেও ধান কিছুটা পাকলেই কাটার সময় ক্ষেতে ঝরে যায়। এতে ফলনে প্রভাব পড়ছে। তাছাড়া অনেক স্থানীয় কৃষক এখনো কিছু জমিতে আদি বোরো ধান কাটতেও দেখা গেছে।

জামালগঞ্জের দুর্গম রাজারবাজ গ্রামটি চারদিকেই ছোট ছোট বিভিন্ন হাওর রয়েছে। বাড়ির পাশের লম্বাবিল ও বালুচর হাওরের কান্দায় গ্রামের কৃষক সুন্দর আলী (৬৫) স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে খলা তৈরি করছেন। অন্যরাও হাওরে আছে।
তিনি বলেন, বৈশাখে হাওরের নারী পুরুষ সবাই সমান কাজ করে। পুরুষরা হাওরে এবং নারীরা খলায় সারাদিন কাজ করেন। ধানকে ‘রিজিক’ তুলনা করে এই কৃষক বলেন, রিজিক সংগ্রহের সংগ্রাম অনেক কঠিন। আমরা যুগযুগ ধরে বৈশাখে এই সংগ্রাম করি। বছর ভালো হলে কষ্ট স্বার্থক হয়। উৎসব রঙিন হয় বলে জানান এই অভিজ্ঞ কৃষক। এই উপজেলার গাজিপুর গ্রামের কৃষক মোজাম্মিল আলী (৭০) কে দেখা গেল খলায় কাজ করতে। খলার পাশেই তার ধানক্ষেত। কিছু ধান কাটা পড়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। তিনি বলেন, এবার হাইব্রীড আর উফশী ধান করেছি ৩ একর জমিতে। ধানও কেয়ার প্রতি (৩০ শতাংশে এক কেয়ার) ১৫-২০ মণ হবে। যদি শেষ পর্যন্ত সব ধান গোলায় তোলতে পারি তাহলে লাভবান হতে পারবো। এই ধান বিক্রি করে বছরের খোরাকিসহ চিকিৎসা, বিয়েশাদি, সংসারের অন্যান্য খরচ ব্যয় করবেন তিনি। জীবনের আনন্দ বেদনার অনুষঙ্গে এই ফসল জড়িত।
আরো কিছুদূর এগিয়ে কলকতখা এলাকায় দেখা যায় যুবক বুরহান উদ্দিন ধানকাটা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। বুরহান উদ্দিন জানালেন, এখন শ্রমিক সংকট বেশি। আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকরা ধান কাটতে আসতেন। এখন আর কেউ আসেন না। স্থানীয় শ্রমিকের উপরই নির্ভর করেন কৃষক। সরকার কম্বাইন হার্ভেস্টর দিলেও এগুলো গভীর হাওরে যেতে পারেনা। তাই শ্রমিকের উপরই নির্ভর করতে হয়। এ কারণে প্রতি বছর শেষ দিকে হাওরের কিছু জমি পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় বলে জানান তিনি।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত সুজন বলেন, আমাদের হাওরের উৎসবের নাটুকে রঙ থাকেনা। এখানে প্রাণের নির্যাস জড়ানো রঙ রয়েছে। আমরা এখন নারী পুরুষ সবাই হাওরমুখি। ধান না তোলতে পারলে আমাদের পুরো বছর পস্তাতে হয়। হাহাকার করতে হয়। তাই যুগযুগ ধরে আমরা এভাবেই বৈশাখে ধান তোলা উৎসব করি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা আজাদ বলেন, হাওরে এবার ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ থেকে উৎপাদন হবে ৯ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৩ মে. টন চাল। যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরের ১১.০৫ ভাগ ধান কাটা হয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ৬১৩ হেক্টর।
হাওরের সব ধান এখন কাটার উপযুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, এই সপ্তাহ থেকে টানা সাতদিন উজান ও ভাটিতে বর্ষণ হবে। তাই ফসল কেটে তোলতে হবে। প্রশাসন মেশিন ও শ্রমিকসহ নানাভাবে সহযোগিতা করবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ