সুনামগঞ্জ , রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫ , ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পাউবো-ঠিকাদার যোগসাজশে নামমাত্র কাজ, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ধীরে ধীরে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির ইচ্ছা, শীর্ষে শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবছে না দল দিরাইয়ে সুলফির আঘাতে যুবক নিহত ঝুলে আছে খাসিয়ামারা সেতু নির্মাণ গাঁজাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার নাসরিন সুলতানা মেধাবৃত্তি পরীক্ষার পুরস্কার বিতরণ নিয়ন্ত্রণরেখা উত্তপ্ত, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ফের গোলাগুলি সিলেট বিভাগে ৪৯ শতাংশ ধান কাটা শেষ রাতের আঁধারে কৃষকের ধানের স্তূপে দুর্বৃত্তদের আগুন দোয়ারাবাজার-কপলা সড়ক সংষ্কার কাজে অনিয়মের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর মানববন্ধন জামালগঞ্জে ৪০ কেজি গাঁজাসহ ১ নারী আটক হারভেস্টার ও শ্রমিক সংকটে বিপাকে কৃষক বোরো’র ঘ্রাণে মুখর হাওর মেঘালয়ে পরিবেশ বিনাশের দায় মেটাচ্ছে তাহিরপুর উপাচার্যকে নিয়ে অভিযোগের প্রতিবাদে সুবিপ্রবি’র শিক্ষার্থীদের নিন্দা জগন্নাথপুরে দুশ্চিন্তায় কৃষক, মেশিন ও শ্রমিক সংকটে ধানকাটা ব্যাহত সিলেটে ‘লাকড়ি তোড়া’ উৎসবে ভক্তদের ঢল কমিউনিটি ক্লিনিকে পরিবর্তন আসছে ধান-চাল ক্রয়ে কোনও সিন্ডিকেট থাকবে না : খাদ্য উপদেষ্টা মধ্যনগরে পলাতক আসামি গ্রেফতার

উৎকণ্ঠার মধ্যেই হাওরে ধান কাটার ধুম

  • আপলোড সময় : ১৮-০৪-২০২৫ ০১:২৪:১৪ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৮-০৪-২০২৫ ০১:৫৫:৪৯ পূর্বাহ্ন
উৎকণ্ঠার মধ্যেই হাওরে ধান কাটার ধুম
তানভীর আহমেদ::
সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে দুলছে ধানের সোনালী শিষকৃষকদের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত নতুন ধানের - গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক

একদিকে হাওরে চলছে ফসল কাটার উৎসব, অন্যদিকে কেউ কেউ কাটা ধান মাড়াই করছেন। অনেকে আবার খলায় ধান শুকাচ্ছেন। অনেকে বাতাসে ধানের চিটা ছাড়াচ্ছেন। তৈরি করছেন ধানখলা (ধান মাড়াই ও ধান শুকানোর স্থান)। কেউ-কেউ গোখাদ্য হিসেবে খড়ও শুকাচ্ছেন। ধানখলায় পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন হাওরাঞ্চলের নারীরাও। হাওরে সপ্তাহখানেক আগ থেকে টুকটাক ধান কাটা শুরু হলেও বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। চাষিদের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। তবে এর মধ্যে আছে উদ্বেগও।
১৮ এপ্রিল থেকে সপ্তাহব্যাপী উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসের কথা জানিয়েছে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এমন পূর্বাভাসে সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই হাওরে জমির ধান পেকে গেলে দ্রুত সেগুলো কাটার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসন, কৃষি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সময়টায় সুনামগঞ্জে ও জেলার উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এবছরও ১৮ এপ্রিল থেকে আগামী এক সপ্তাহ সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। উজানে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে আগাম বন্যা দেখা দেয় হাওরে। ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল নামলে হুমকিতে পড়ে হাওরের একমাত্র ফসলরক্ষা বাঁধগুলো।
আবার অনেক সময় ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজে অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে অল্প পানির চাপেই ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে কিংবা বাঁধ উপচে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। এ নিয়ে শঙ্কায় থাকেন হাওরবাসী।

বৃহস্পতিবারও জেলার বিভিন্ন এলাকায় থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা বলছেন, বোরো মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ধানের ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে।
তবে মার্চ মাসের খরা উৎপাদনে কিছুটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে সবমিলিয়ে এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলেও দাবি তাদের। তাঁদের মতে, অন্যান্য বছরের মতো এবারও সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা থাকায় তাদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে এ-সব উদ্বেগ-উৎকন্ঠা নিয়েই পুরোদমে চলছে হাওরে বোরো ধান কাটা।
একদিকে আগাম বন্যার ঝুঁকি অন্যদিকে চাষিদের অর্থ সংকটকে কাজে লাগিয়ে পানির দরে নতুন ধান সংগ্রহের জন্য মাঠেই ভিড় করছে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী বা ফড়িয়া। তাঁরা (ফড়িয়া) খলা থেকেই নতুন ধান সংগ্রহ করে মজুত করে বাড়তি ফায়দা লোটার পাঁয়তারা করছে। একইসঙ্গে রয়েছে পাওনাদার-দাদনদারদের সুদের অর্থের তাগিদ। এ যেন আনন্দোৎসবে বেদনার বাঁশি বেজে ওঠার পরিস্থিতি। এদিকে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ও নদনদীর পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা বিবেচনায় দ্রুত ধান কর্তন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে গত মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) পাউবো সুনামগঞ্জ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী সাত দিনের মধ্যে সুনামগঞ্জের সুরমা, কুশিয়ারা, ভৈরব-কুলাউড়া এবং মেঘনা-বৌলাই নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে হাওরাঞ্চলের পাকা বোরো ফসল বন্যার কবলে পড়তে পারে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এই ধানের বর্তমান বাজার মূল্য ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধানের ক্ষয়ক্ষতি না হলে এবং হাওরের সপূর্ণ ধান কৃষক গোলায় তোলতে পারলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এবছর জেলায় কৃষকদের ধান কাটতে ৭৩ হাজার শ্রমিকের পাশাপাশি ১৬০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৫টি রিপার মাঠে রয়েছে। সরেজমিন জেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে-হাওরে পাকা ধান কাটছেন কৃষকরা। অনেকে কাটা ধান মাড়াই করছেন, অনেকে শুকাচ্ছেন। অনেকে বাতাসে ধানের চিটা ছাড়াচ্ছেন। তৈরি করছেন ধানখলা ও খলাঘর। অনেকে গোখাদ্য হিসেবে খড়ও শুকাচ্ছেন। ধানখলায় (ধান শুকানো ও নাড়ার স্থান) পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করছেন। সবমিলিয়ে বলা যায় ধীরে ধীরে বোরোধান নিয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে হাওরের কৃষকদের। যে কোন মূল্যেই তাঁরা তাদের শ্রম-ঘামে ফলানো একমাত্র ফসল গোলায় তোলতে চান। তাহিরপুর উপজেলার বৃহত্তর শনির হাওরের কৃষক জুবায়েল মিয়া বলেন, এইবার তুলনামূলকভাবে অনেক আগেই ধান কাটা শুরু হইছে। ফলনও মোটামুটি ভালো হইছে। তিনি বলেন, একসময় হাওরে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আসতেন। এখন এটা একবারে কমে গেছে। স্থানীয়ভাবেও অনেকসময় শ্রমিক মিলে না। তাই এখন ধান কাটার মেশিনের ওপরই সবার ভরসা। সবাই মোটামুটি মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের কৃষক সামিউল ইসলাম বলেন, হাওরাঞ্চলে যে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তাতে আমরা কিছুটা আতঙ্কে আছি। পাহাড়ি ঢল যদি নামে তাহলে আমাদের ফসলগুলো হুমকিতে পড়বে। বেশিরভাগ ধান এখনও পাকেনি। প্রতিবছরই এমন আতঙ্কে অনেকেই কাঁচা ধান কেটে ফেলেন। এতে কিন্তু আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাটিয়ান হাওরের কৃষক আব্দুল হক বলেন, এইবার বেশি জমি করছি না, ১৮ কিয়ার জমি করছি মাত্র। ধান এখনও পাকছে না। আরও ৪-৫ দিন যাইবো পাকতে। না পাকাইয়া কাটতাম না। শুনছি বৃষ্টি হইবো, বৃষ্টি হইলেও তো আর কিছু করার নাই। কাঁচা ধান কেটেই আর কি করমু। ধানের ফলন কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তুলনামূলক ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে এবছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ফলনে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, জেলার প্রতিটি হাওরেই ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই হাওরের ধান শতভাগ কাটা হয়ে যাবে। ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্র, শ্রমিক প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, এবছর ফসলের মাঠের অবস্থা ভালো। এবছর হাওরে প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে। ধান কাটা ও গোলায় তোলায় কৃষকদের সহযোগিতার জন্য জেলার কৃষি বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ধান কাটা থেকে শুরু করে গোলায় তোলা পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের একটি তথ্য পেয়েছি, যে ১৮ এপিল থেকে ভারতের মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি সুনামগঞ্জের অভ্যন্তরে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি হাওরের অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে আতঙ্কিত না হয়ে আমরা কৃষকদের বলবো, হাওরে পাকা ধান যেন কালবিলম্ব না করে দ্রুত কেটে ফেলেন। তিনি বলেন, এবার অন্য বছরের তুলনায় সার্বিক পরিস্থিতি এখনো ভালো আছে। ধান তোলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি বাঁধের নজরদারি রাখা হবে কৃষকেরা তাঁদের শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান নির্বিঘ্নে  গোলায় তুলতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করি।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ