বোরো ধান কাটার ধুম, হাওরে বৈশাখী হাসি
- আপলোড সময় : ১৪-০৪-২০২৫ ০৮:১৮:০৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-০৪-২০২৫ ০৮:১৮:০৮ পূর্বাহ্ন

মো. শাহজাহান মিয়া ::
হাওরে বৈশাখ আসে নতুন ফসলের সুবাসে, কিষাণ-কিষাণির নির্মল হাসিতে। এ বছর নানা শঙ্কা কাটিয়ে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন হাওরজুড়ে চলছে ধান কাটার ধুম। এতে কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের হাসি। জমির পাকা ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। যে যেভাবে পারছেন ধান কাটায় ঝাপিয়ে পড়ছেন। কার আগে কে ধান কাটবেন, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। সবাই চান, প্রকৃতি অনুকূলে থাকতে দ্রুত ধান কেটে গোলায় তুলতে। যে কারণে ধানকাটা, মাড়াই করা, শুকানো ও ঘরে তোলা নিয়ে চারদিকে কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে ধানকাটা উৎসবে মেতে উঠেছে হাওর। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার হাওর থেকে প্রায় ৯ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৩ মে.টন চাল বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কবল থেকে নিরাপদে হাওরে বোরো ফসল কৃষকের গোলায় তোলতে করণীয় নির্ধারণ করেছে জেলা প্রশাসন। ধান পাকার সাথে সাথে দ্রুতই কেটে ফেলতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ধান কাটা জন্য রয়েছে ১১০০ মেশিন ও প্রায় ২ লাখ শ্রমিক। ধান কাটতে কৃষকদের সকল ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি বোরো ফসলের সুরক্ষা ফসলরক্ষা বাঁধের নজরদারি বাড়াতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া।
হাওরের বোরো ফসল সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে কর্তন এবং কৃষকের গোলায় তোলা পর্যায়ে করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ধান কাটা শুরু হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকবে। তবে ১৫-২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধান কর্তনের পিক আওয়ারের বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের আশঙ্কা থাকায় এই সময়ের আগেই হাওরের বেশির ভাগ জমির ধান কেটে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হয়।
অপরদিকে, অনেকে জমির মাড়াই করা কাচা ধান হাওর থেকেই কম দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া কাচা ও শুকনো ধান কিনতে হাওর এবং মাঠে ঝাপিয়ে পড়েছেন ধান ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষক জানান, এখন ধানকাটাসহ অন্যান্য খরচ জোগান দিতে তারা কাচা ধান বিক্রি করছেন।
রবিবার সরেজমিনে জগন্নাথপুর উপজেলার নারিকেলতলা নয়াবন্দ হাওরে গিয়ে দেখা যায়, হারভেস্টার মেশিন ও শ্রমিকদের দিয়ে ধানকাটা চলছে। এ সময় কৃষক এনামুল হক জানান, গত কয়েক দিন আগে ঝড়ের সাথে হালকা শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। এতে ধানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। তবে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। যা পেয়েছি তাতেই অনেক খুশি হয়েছি। যদিও এবার ধানকাটা ও হাওর থেকে বাড়িতে নেয়ার পরিবহন খরচ অনেক বেশি মনে হচ্ছে। অন্যদিকে হাওরে অন্য কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কেটে বস্তাবন্দি করতে দেখা যায়।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জগন্নাথপুরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ বেড়েছে। তাই ফলনও বেশি হয়েছে। এবার জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর সহ সকল হাওর ও বাওরে মোট ২০ হাজার ৪২৩ হেক্টর বোরো জমি আবাদ হয়েছে। তা থেকে সরকারি ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৪২০ মেট্রিকটন ধান। এবার সময়ে সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে। বর্তমানে হাওরে পুরোদমে ধানকাটা চলছে। ধান কাটতে এ পর্যন্ত আমাদের স্থানীয় ৫২টি ও বহিরাগত ২২টি সহ মোট ৭৪টি হারভেস্টার মেশিন হাওরে নেমেছে। এছাড়া স্থানীয় ৯ হাজার ও বহিরাগত ৬ হাজার সহ প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ধান কাটছেন। আশা করছি, সময়ের আগেই বাম্পার বোরো ধান কৃষক ভাইদের গোলায় উঠবে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই হাওরের ধান শতভাগ কাটা হয়ে যাবে। ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্র, শ্রমিক প্রস্তুর রয়েছে। ৫ এপ্রিল থেকে প্রতিটি হাওরেই ধান
কাটা শুরু হয়েছে। এবার হাওর থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার উপর ধান উৎপাদন হবে।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের হাওরে বৈশাখজুড়ে অন্য রকম এক উৎসব চলে। এটি কৃষকের শ্রমে-ঘামে জমিতে ফলানো সোনার ধান গোলায় তোলার উৎসব। এই উৎসবে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই যোগ দেন। এমনকি গ্রামের বাইরে থাকা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসেন পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা করতে। এই ধানের ওপরই পুরো পরিবারের এক বছরের খাবার, সব ব্যয়, বিয়েশাদি ও সন্তানদের লেখাপড়া নির্ভর করে। এই ধান তুলতে পারলেই হাওরপাড়ের কৃষকেরা ‘ধনী’। কোনো কারণে গোলায় ধান না উঠলে হাওরে বেদনা ভর করে। কৃষক পরিবারে কষ্টের সীমা থাকে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ