স্ম র ণ
‘গানের পাখি’ সুষমা দাশ
- আপলোড সময় : ১৩-০৪-২০২৫ ০১:০১:২০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৪-২০২৫ ০১:০১:২০ পূর্বাহ্ন

ওবায়দুল মুন্সী
সুনামগঞ্জের রত্ন ছিলেন প্রখ্যাত লোকশিল্পী সুষমা দাশ। আমরা মাসীমা বলে ডাকতাম। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম গুরুজী শ্রী বিদিত লাল দাসের মাধ্যমে। ২০০৫ সালে আমি ‘নীলম লোক সংগীতালয়’ শেখঘাট সিলেটে ছিলাম। যে সংগীত বিদ্যালয়ে এসে গেছেন দেশের নাম করা অনেক সংগীত শিল্পী। একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত শিল্পী সুবীর নন্দীও এই বিদ্যালয়ে যুবক বয়সে গানের তালিম নিয়েছেন। সেই সুবাদে মাসীমাও একদিন এখানে এসেছিলেন। মাসীমা সুষমা দাশের অসাধারণ কণ্ঠ শুনে আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। অসংখ্য লোককবির গান তাঁর মুখস্ত ও সংগ্রহে ছিল। আর সেই গানগুলো কোনো কাগজের ডায়েরিতে নয়! তাঁর মনের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন প্রাচীন লোককবিদের দুই হাজারেরও বেশি গান। এজন্য তাঁর আরেক নাম ছিল ‘গানের পাখি’।
বাংলা লোকসংগীতের অন্যতম প্রধান শিল্পী, প্রাচীন লোকগানের চাক্ষুষ সাক্ষী, সুললিত কণ্ঠের অধিকারী একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ লোকসংগীত শিল্পী শ্রীমতি সুষমা দাশ ১৯৩০ সালের ১ মে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত লোককবি রসিকলাল দাশ, মাতা সংগীত রচয়িতা দিব্যময়ী দাশ।
ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সুষমা দাশ ছিলেন সবার বড়। তাঁর আপন ছোট ভাই একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত সংগীত সাধক ওস্তাদ রামকানাই দাশ। গুরুজীর মুখ থেকে শুনেছি, তিনি ভালো তবলা বাজাতে পারতেন। গুরুজীর গানের সাথেও অনেক সময় তবলা বাজিয়েছেন।
কর্মজীবনে সুষমা দাশ যেমন একজন প্রখ্যাত লোকসংগীত এবং বাংলাদেশ বেতার সিলেটের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন, ঠিক তেমনি সংসার জীবনও একজন সফল গৃহিণী ছিলেন। তাঁর গাওয়া প্রাচীন ২২৯টি গান, জীবনী, সাক্ষাৎকার নিয়ে আজিমুল রাজা চৌধুরী ‘সুষমা দাশ ও প্রাচীন লোকগীতি’ নামে একটি বই ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশ করেন। এটিই তাঁকে এবং তাঁর গান নিয়ে রচিত প্রথম বই। প্রাচীন অনেক লোকবিদের গান করেছেন সুষমা দাশ। যেমন- সৈয়দ শাহনূর, শিতালং ফকির, দ্বীন ভবানন্দ, কালা শাহ, লালন সাই, আরকুম শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণ, মদনমোহন, উকিল মুন্সী, জালাল খাঁ, দ্বীনহীন, অধরচান, রামজয় সরকার, শ্যামসুন্দর, দুর্গাপ্রসাদ, রসিক লাল দাশ, কামাল পাশা, দুর্বিণ শাহ, শাহ আবদুল করিম, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।
কোনো বই বা পা-ুলিপির সাহায্য ছাড়াই তিনি ৯০ বছর বয়সেও শুদ্ধ বাণীতে গান পরিবেশন করেছেন। তিনি নিজেও কয়েকটি গান লিখেছেন তবে সেগুলো সংখ্যায় কম। তিনি সাধারণত যে ধারার গান গেয়েছেন তা হলো- পল্লীগান, কবিগান, লোকগান, হোরিগান, ঘাটুগান, ধামাইল, সূর্যব্রত, পালাগান, কীর্তন, মনসা, গোষ্ঠলীলা, সুবল মিলন, বাউলা, ভাটিয়ালী, পীর মুর্শিদি ইত্যাদি।
লোকশিল্পী সুষমা দাশের পারিবারিক জীবনে চার ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
মাসীমার সাথে আমার আরেকবার দেখা হয়েছিল একটি গানের মঞ্চে ১৪১৬ বঙ্গাব্দে। তখনও তিনি একুশে পদক পাননি! বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে, পূজা-পার্বণে তিনি নিরলস গান করে যাচ্ছিলেন। সেদিন কয়েকটি লোকগান ও ধামাইল শুনেছিলাম মাসীমার কণ্ঠে। ৭৯ বছরের মাসীমার কী সুরের গলা! যেন বিদ্যাদেবী প্রবিষ্ট হয়েছিলেন মাসীমার ওপর।
তারপর দেখা হয়েছিল নজরুল একাডেমি জিন্দাবাজার সিলেট কোনও এক অনুষ্ঠানে। নাম মনে পড়ছে না! কোনো এক বাউল সংগঠন থেকে তাকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন এবং পাশে বসতে বললেন। আমি বসার পূর্বেই মাসীমার সাথে একটা সেলফি তুলেছিলাম। এই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। সেদিন মাসীমার শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল। আমাকে বলেছিলেন যে, ওদের কথা দিয়েছি বলে না এসে পারলাম না। সেই থেকে মাসীমা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। হঠাৎ ফেইসবুক থেকে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ স¤পাদক বন্ধুবর মোস্তাক আহমেদের পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম তিনি আর নেই!
২৬ মার্চ ২০২৫ স্বাধীনতা দিবসে ৯৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগভোগে তিনি দেহত্যাগ করেন। মর্ত্যলোকে স্বদেহে তাকে দেখতে পারবো না, মঞ্চে শোনবো না আর গান! তবুও স্বর্গলোকে তিনি গাইবেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ