সুনামগঞ্জ , বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ , ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
হাসপাতাল চালুর দাবিতে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ হাওরে চড়ক উৎসবে মানুষের ঢল ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা, দ্রুত পাকা ধান কাটার আহ্বান বন্যার ঝুঁকিতে হাওরাঞ্চল তিন দপ্তরের ছুটি বাতিল গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতায় নিহত বেড়ে ৫১ হাজার, নিখোঁজ ১১০০০ ধর্মপাশায় দুই আসামি গ্রেফতার বিএনপি’র ঈদ পুনর্মিলনী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে নববর্ষ উৎসব ডাকসু নির্বাচনের কমিশন গঠন মে মাসে এই সরকারকে ৫ বছর চাওয়ার কথা আমার নয়, জনগণের : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাগর-রুনি হত্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছালো ১১৮ বার সুনামগঞ্জ শহরের শৃঙ্খলার জন্য অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা নববর্ষের প্রত্যাশা, বিজন সেন রায় বোরো ধান কাটার ধুম, হাওরে বৈশাখী হাসি আমাদের পহেলা বৈশাখ ছাতকসহ দেশের ১০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা বাতিল ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে জাতীয় পার্টির বিক্ষোভ

বাম্পার ফলনের আশায় হাওরের ১০ লাখ কৃষক

  • আপলোড সময় : ১০-০৪-২০২৫ ১২:৪৫:৪৫ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১০-০৪-২০২৫ ১২:৫১:৩৮ পূর্বাহ্ন
বাম্পার ফলনের আশায় হাওরের ১০ লাখ কৃষক
শামস শামীম ::
বাংলা ক্যালেন্ডারে এখনো চৈত্র মাসের বাকি আছে চারদিন। এর মধ্যে এক সপ্তাহ আগ থেকেই হাওরে দেশি বোরো ধান বা আদি ধান গচি, টেপি, লালডিঙ্গাসহ হাইব্রীড সিনজেনটা, হীরা-১,২, সুরভিসহ কিছু প্রজাতির ধান কাটা শুরু হয়েছে। সরকারি হিসেবে বুধবার পর্যন্ত জেলায় প্রায় ৬০০ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নে দেখার হাওর থেকে ধান কাটা কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোদমে হাওরে সব প্রজাতির ধান কাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এবার হাওর থেকে প্রায় ৯ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৩ মে.টন চাল বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে গত দুইদিন খরচার হাওর, শনির হাওর ও দেখার হাওর ঘুরে দেখা গেছে, সবুজের খোলস ছেড়ে হলুদাভ রূপ নিয়েছে হাওরের বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ধান কাটা, জাঙ্গালে ধান মাড়াই, শুকানো ও শুকানো ধান সিদ্ধ দেওয়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ধানখলা বা ধান প্রক্রিয়ার স্থান। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা। তবে কিছু কিছু ধানে চিটা হওয়ায় ক্ষতিরও আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষক।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় চার লাখ চাষী পরিবার বোরো চাষে জড়িত আছেন। সব মিলিয়ে বোরো চাষীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। হাওরের এক ফসলি জমির উপরই নির্ভরশীল এসব কৃষক বোরো ধানের ফলনের উপরই তাদের জীবন আবর্তিত হয়।
সরেজমিনে পরিদর্শন ও কৃষি বিভাগের মতে ৫ এপ্রিল থেকে হাওরে বিচ্ছিন্নভাবে ধান কর্তন শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হাওরের শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে। এবার হাওরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর। অর্জন হয়েছে ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর। এ থেকে উৎপাদন হবে ৯ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৩ মে. টন চাল। চাষকৃত বোরো ধানের মধ্যে হাওরে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ১৬৮ হেক্টর এবং নন হাওরের ৫৮ হাজার ২৪২ হেক্টর জমি চাষ হয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে হাইব্রীড ৬৫ হাজার ২০০ হেক্টর, উফসী ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ২১০ হেক্টর, স্থানীয় ১ হাজার হেক্টর চাষাবাদ হয়েছে। এতে ধান উৎপাদন হবে প্রায় ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৫ মে. টন। হাওরে এবার বিআর ২৯, ২৯, ৮৮, ৮১, ৮৯, ৯২ চাষ হয়েছে বেশি। হাইব্রীডের মধ্যে সিনজেনটা, হীরা-১,২, সুরভি, এসএলএইটএইচ, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির রয়েছে। আর দেশি যে অল্প ধান রয়েছে তার মধ্যে দেশি গচি, টেপি, বোরো আবাদ করা হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। হাইব্রীড কেয়ার (প্রতি ৩০ শতক) প্রায় ৩০ মণ ফলন হয়েছে। উফশী ১৫ মন এবং স্থানীয় ৭-৮ মণের মতো কেয়ার প্রতি ফলন হয়েছে। ধান কাটার শ্রমিক ও যন্ত্র : কৃষি বিভাগের মতে জেলায় সচল কম্বাইন হার্ভেস্টর রয়েছে ৬৯৯টি। অচল আছে ১০০টি। সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে ৭০টি। বাইরের জেলা থেকে ধান কাটার জন্য আরো ২৩৬টি আসার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৭৯টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ১৭০টি রিপার যন্ত্র রয়েছে ধান কাটার জন্য। তাছাড়া ধান কাটার জন্য প্রস্তুত আছে স্থানীয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৭০ শ্রমিক, বাইরের জেলা থেকে আগত ২৪ হাজার ২৩০ জন এবং বালু মহালের আরো প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করবে। সূত্র জানায় একটি কম্বাইন হার্ভেস্টর মেশিনে দৈনিক ৩০ বিঘা ও একটি রিপান মেশিনে প্রতিদিন ৫ বিঘা জমির ধান কাটতে পারে। এছাড়াও ১ জন শ্রমিক গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ধান কাটতে পারেন। ঝড়-বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে ক্ষেতে বেশি ধান না পাকাতে কৃষকদের সতর্ক করে ৭০-৮০ ভাগ ধান পাকলেই কেটে ফেলার আহ্বান জানিয়েছে কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসন। সরকার ভর্তুকিতে বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে কৃষকদের যেসব কম্বাইন হার্ভেস্টর প্রদান করেছে তার মধ্যে এখনো ১০০টি অচল আছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। তবে কৃষকদের মতো এই সংখ্যা আরো বেশি। এগুলো সচল বা মেরামত করে দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলোকে চিঠি লেখলেও এখনো সবগুলো মেরামত করা হচ্ছেনা। ১৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টরের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৭০টি সচল করে দিয়েছে। এখনো ১০০টি রয়ে গেছে অচল।
কৃষকদের বক্তব্য : সরেজমিন ৮ এপ্রিল দেখার হাওরের শিয়ালমারা ও বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওরে গিয়ে দেখা যায় ধান কাটছেন শ্রমিকরা। বিভিন্ন স্থানে যন্ত্রে ধান কাটা হচ্ছে। ধানের জন্য খলা প্রস্তুত করছেন কৃষক। অনেকে কাটা ধান সিদ্ধ করছেন। কেউ কেউ মাড়াইও করছেন যন্ত্রে। দেখার হাওরে দুই ছেলেকে নিয়ে বিআর ২৯ ধান কাটছেন ইসলামপুর গ্রামের কৃষক শাহিদ মিয়া। তিনি বলেন, এবার বিআর ৮৮ ও ৮১ লাগিয়েছিলাম কৃষি বিভাগের পরামর্শে। এখন এই ধানও অর্ধেকের কাছাকাছি নষ্ট হয়ে গেছে। শ্রমিকরা কাটতে চায়না। তাই নিজেরাই কেটে তুলছি। এবার প্রায় ১৫০ শতক জমিতে তিনি ক্ষেত করেছেন বলে জানান। ধান নষ্ট হওয়ায় তার মূলধনই ওঠা কষ্টকর হবে।
পাশেই মধুপুর গ্রামের কৃষক শামসু মিয়ার ক্ষেতের ধান কাটছিলেন আমিরপুর গ্রামের শ্রমিক অনিল চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, এই ধান কেটে আমাদের পোষাচ্ছেনা। চিটা বেশি। গৃহস্থ-শ্রমিক কেউ লাভবান হতে পারবেনা। যারা বিআর ২৯সহ, ৮৮, ৮১ ধান লাগিয়েছে তাদের অনেকেরই ফসলের ধান নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। মধুপুর গ্রামের কৃষক সমুজ আলী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এই ধান লাগিয়ে মাইর খাচ্ছি। আমরার আর পোষছেনা।

একই গ্রামের কৃষক মো. শফিক মিয়া বলেন, ১৮০ শতক জমিতে বোরো আবাদ করেছি। এর মধ্যে বিআর ২৯ ধান অর্ধেক নষ্ট হইছে। তবে ৯২, সুরভি ও ঝলক ভালো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে পানির অভাবে কিছু ক্ষেতের বিআর ২৯, ৮১, ৮৮ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা বিআর-২৮, ২৯ লাগাতে কৃষকদের বারণ করার পরও তারা চাষ করেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই হাওরের ধান শতভাগ কাটা হয়ে যাবে। ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্র, শ্রমিক প্রস্তুত রয়েছে। ৫ এপ্রিল থেকে প্রতিটি হাওরেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে আগামী সপ্তাহের প্রথম দিন থেকেই ধান কাটার ধুম পড়বে প্রতিটি হাওরে। এবার হাওর থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার উপর ধান উৎপাদন হবে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন গত ৬ এপ্রিল হাওরের বোরো ধান নির্বিঘ্নে উত্তোলন নিয়ে মতবিনিময় করে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার কৃষি উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে ধান কাটা উদ্বোধন করবেন।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে হাওরে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষেতের ধান ৭০-৮০ ভাগ পেকে গেলেই আমরা কর্তনের কথা বলেছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষকদের ধান গোলায় তোলতে সব ধরনের প্রস্তুতি ও সহায়তা রয়েছে। উল্লেখ্য, চলতি বোরো মওসুমে জেলার ৫৩টি হাওরের প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত, সংস্কার ও পুননির্মাণে ৬৮৭টি পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) কাজ করেছে। প্রতিটি পিআইসিতে সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে সর্বমোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২৭ কোটি টাকা। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজ শেষ করা হয়েছে ১০ মার্চ। তবে এবারও কাজ নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা হয়েছে বলে মানববন্ধন করে জানিয়েছিল হাওর বাঁচাও আন্দোলন।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স