সুনামগঞ্জ , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস পলাশ ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল আহমদ কারাগারে মুজিববর্ষ উদযাপনে খরচ ১২৬১ কোটি টাকা পুলিশের নতুন আইজিপি বাহারুল আলম লাখে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় শিক্ষা কর্মকর্তাকে জামালগঞ্জে অগ্নিকান্ডে দুটি বসতঘর পুড়ে ছাই ধর্মপাশায় আসামি গ্রেফতার শহরে ফুটপাত দখল করে দোকানপাট: যানজটে জনভোগান্তি পিকনিক স্পটে দুর্বৃত্তদের হামলা ও ভাঙচুর ৭০ লাখ টাকার চোরাই পণ্য জব্দ তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে আ.লীগের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নেই : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জামালগঞ্জে এক পরিবারের ৩ বসতঘর পুড়ে ছাই ব্যাংকের সব শাখায় ১, ২ ও ৫ টাকার কয়েন লেনদেনের নির্দেশ সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ৮ দিনের রিমান্ডে সারদায় প্রশিক্ষণরত আরও তিন এসআইকে অব্যাহতি আ.লীগের পুনর্বাসনে চেষ্টাকারীরা গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ খেলাপি আদায়ে অর্থ ঋণ আদালতকে সক্রিয় করছে সরকার সংস্কার শেষে নির্বাচন কোনো যৌক্তিক কথা নয় : মঈন খান ফোকাস এখন একটাই- নির্বাচন : মির্জা ফখরুল

বাংলাদেশে নজিরবিহীন বন্যা : এক জাতীয় সংকট ড. মতিউর রহমান

  • আপলোড সময় : ৩০-০৮-২০২৪ ০৯:২৬:৩৬ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ৩০-০৮-২০২৪ ০৯:২৬:৩৬ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশে নজিরবিহীন বন্যা : এক জাতীয় সংকট ড. মতিউর রহমান
বাংলাদেশ আবারও ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে, যা ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের উজান থেকে আসা পানির স্রোতের ফলে আরও তীব্র হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা যায় যে, চলমান এই আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১টি জেলায় প্রায় ৯লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮ জন মানুষ আটকা পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু মানবজীবনকে অবরুদ্ধ করেনি, বরং অর্ধ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ও কল্যাণকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বন্যার ব্যাপকতা অত্যন্ত গভীর। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, উল্লিখিত জেলার ৭৭টি উপজেলার ৫৮৭টি ইউনিয়নে প্রায় ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন মানুষ সরাসরি বন্যার প্রভাবের শিকার হয়েছেন। এই মানুষগুলো তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা এবং মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্লাবিত এলাকাগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা মৌলিক সেবাসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত বন্যায় ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। মৃতদের মধ্যে চট্টগ্রামে পাঁচজন, কুমিল্লায় চারজন, নোয়াখালীতে তিনজন, কক্সবাজারে তিনজন এবং ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে রয়েছেন। এই প্রাণহানি দুর্যোগের মারাত্মক প্রকৃতি নির্দেশ করে এবং জরুরিভিত্তিতে কার্যকর দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী একদিকে প্রিয়জন হারানোর শোক নিয়ে রয়েছে, অন্যদিকে জীবিকা পুনর্গঠনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সরকার ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে, যেখানে বন্যাকবলিত মানুষরা আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রগুলোতে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন মানুষ এবং ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদিপশু অবস্থান করছে। তবে, এত সংখ্যক মানুষ আশ্রয় নেওয়ায় কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং পর্যাপ্ত স¤পদের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলছে। সরকার বন্যাপীড়িতদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ১১টি জেলায় ৭৭০টি মেডিকেল টিম মোতায়েন করেছে। এই টিমগুলো আহতদের চিকিৎসা, পানিবাহিত রোগের বিস্তার রোধ এবং অন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে নিরলসভাবে কাজ করছে। তবে, পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে স্থানীয় স¤পদের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরিস্থিতি এখনও গুরুতর। বন্যায় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ ফসল এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে গেছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। সেনাবাহিনী ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে এবং খাদ্য ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করছে। তবে, পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে এই প্রচেষ্টা এখনও অপর্যাপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (ঞঝঈ) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানটি বন্যার্তদের জন্য খাদ্য, পানি এবং অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে সহায়ক হচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্যা¤পাসে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করছেন। তারা বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করছেন। এই কার্যক্রমটি শুধু ত্রাণ সংগ্রহই নয়, বরং বন্যার্তদের জন্য একটি নৈতিক সমর্থন এবং সহযোগিতার বার্তা প্রদান করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে এই সংকটকালে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতা প্রদর্শন করছেন, যা প্রশংসনীয়। তাদের এই প্রচেষ্টা বন্যার্তদের সহায়তার পাশাপাশি, সমাজের অন্য অংশকে সংকট মোকাবিলায় আরও সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করবে। বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, এবং চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা নিজেরা কিছু পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করছেন, যাদের সহায়তার ফলে অনেক বন্যার্তের খাবারের অভাব মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। তারা বন্যার্তদের জন্য খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করছেন। কিছু সংস্থা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করছে। এই প্রচেষ্টা বন্যার্তদের জন্য অমূল্য সহায়তা প্রদান করছে এবং তাদের সংকটের সময়ে সাহসিকতা ও সহানুভূতির পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা চলমান সংকটের পূর্ণাঙ্গ সমাধান নয়। এজন্য, সরকারের পাশাপাশি এসব সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অব্যাহত সহযোগিতা এবং সংকট মোকাবিলায় একত্রিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এই বন্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি আবারও প্রকাশ করেছে। একটি নি¤œভূমি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে, বিশেষত বর্ষাকালে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তবুও এই দুর্যোগের পরিসর ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ফাঁকফোকরগুলোকে প্রকাশ করেছে। এই বন্যার পরে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জীবিকা পুনরুদ্ধার এবং সম্প্রদায়গুলোকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের এই সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করার ওপর নতুন করে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। এজন্য প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত করা, অবকাঠামো শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে দুর্যোগের প্রতিক্রিয়ার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় এবং অনিয়ন্ত্রিত ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোর সমাধান করতে হবে, যা দেশের বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। আগস্ট ২০২৪-এর এই ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশের জন্য এক গভীর বাস্তবতা হিসেবে কাজ করেছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায়, ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে তোলার এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে। তবে এটি সরকারের, নাগরিক সমাজের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করছে। সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বন্যার ক্ষতি কমাতে এবং এর জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে সক্ষম হবে। লেখক : গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য