হাওরে ফসলরক্ষা প্রসঙ্গে শাহ আব্দুল করিম:অনুপ তালুকদার
- আপলোড সময় : ১৬-০২-২০২৫ ০১:২৭:৫৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-০২-২০২৫ ০১:২৭:৫৩ পূর্বাহ্ন

১৪২৩ বঙ্গাব্দে চৈত্র মাসে অকাল বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের বোরো মৌসুমের সব ধানি জমি তলিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ নামে একটি সংগঠন (বর্তমানে এর নাম হাওর বাঁচাও আন্দোলন)। তারা ফসলরক্ষা বাঁধে কে কত দুর্নীতি করেছে, কার গাফিলতি কত, এ নিয়ে মাঠে সোচ্চার রয়েছেন। এই প্রশ্ন আরো আগেই তুলেছিলেন ভাটি অঞ্চলের গ্রামীণ মনীষী বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিম উজান ধল নামক অজপাড়া গাঁ থেকে। তিনি প্রথমেই ভাটি অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে-
“হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ জেলার ষোলআনা/নেত্রকোণা কিশোরগঞ্জ নিয়ে সীমানা/ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সঙ্গে রয়েছে/পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে ভাটি দেশ হয়েছে”।
তিনি সম্ভবত হাওর অঞ্চলকেই ভাটি অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই পাঁচ জেলার অধিকাংশ মানুষ একটিমাত্র ফসল বোরো আবাদের উপর নির্ভরশীল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটি মাত্র ফসল ফলায়। বছরে এই ফসলটি নষ্ট হলে তাদের প্রাণে বাঁচা দায়।
তাঁর ভাবনায় তিনি গেয়ে উঠেন- “বন্যার জলে ফসল নিলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে/সুনামগঞ্জবাসী কাঁদে পড়ে পূর্ণগ্রাসে”। অথবা “চৈত্র মাসে বৃষ্টির জলে নিলে বোরো ধান / ভেবে মরি হায় কী করে বাঁচে কি না প্রাণ”।
হাওরপাড়ে বেড়ে ওঠা এই চারণ কবি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির কথা চিন্তা করে। উল্লেখ থাকে যে, সুনামগঞ্জ রায় প্রেস থেকে প্রকাশিত গণ-সঙ্গীত বইয়ের আখ্যাপত্রে তাঁকে কবি আব্দুল করিম বলা হয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন আসে হাওর বলতে কী বুঝায়? হাওর হচ্ছে বিশাল পিরিচাকৃতির নিচু অঞ্চল যা সারা বছরের তুলনায় বর্ষাকালে অধিক পানি দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠে। হাওরের অন্যতম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হলো দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্লাবনভূমির তুলনায় এ অঞ্চল অপেক্ষাকৃত নিচু ও ব্যাপক বিস্তৃত।
সুনামগঞ্জ জেলার ছোট বড় প্রায় সব হাওরের চারদিকে যে নদীগুলো রয়েছে তার উৎপত্তিস্থল উজানের ভারতের মেঘালয় পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সাথে বালি আর পাথরে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীগুলো চৈত্র মাসে হঠাৎ পাহাড়ি ঢল নেমে আসা পানি ধারণ করতে পারছে না বিধায় তা হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়েছে, প্লাবিত হচ্ছে একরে পর এক হাওর। তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। তাছাড়া হাওরে বাঁধগুলো সঠিক সময়ে নির্মাণ না করায় পানির ধাক্কায় (পানিগতিবিদ্যার ভাষায় বলতে হয় পানির বিভিন্নমুখী গতির কারণে) তা সহজে ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে নদীগুলো খনন ও নদীর বাঁকে বাঁকে ¯্রােতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বাঁধের আকার ও ধরন নির্ণয় করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ে কতটুকু গবেষণা হয়েছে তা ভেবে দেখা দরকার।
এ প্রসঙ্গে শাহ আব্দুল করিম বলেন- “এই দেশেতে ফসল রক্ষা বড়ই বিভ্রাট/ দেশের যত নদী নালা হয়েছে ভরাট/ বৃষ্টি হইলে কূল ডুবাইয়া নদীর পানি হাওড়ে চলে, ফসল নিলে সমুলে / নদী খনন না হলে নাই সমাধান”। অথবা “এলাকার মানুষকে বাঁচাইতে যদি চাও / পাহাড়ি জল নেমে যাওয়ার রাস্তাগুলো খুলে দাও / ক্ষমতার মালিক যারা সূক্ষ রাস্তা ধর / কৃষকের ফসল রক্ষার সুব্যবস্থা কর”। এখানে পাহাড়ি জল নেমে যাওয়ার রাস্তা বলতে আমাদের নদ-নদীগুলোকেই বোঝানো হয়েছে যার অধিকাংশের উৎপত্তি পাহাড়ে।
আমি আগেই বলেছি, নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া নদীর গন্তব্যস্থল সাগরের মোহনায় পলি জমে যাওয়ার ফলে নদীর ¯্রােতধারা আগের মতো তীব্র হতে পারছে না। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের (বৈশি^ক উষ্ণায়ণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমি ও পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, উজানের পাহাড়ের বরফগলা এবং এ জন্য বর্ধিত পলির আগমন, নদীতীর ক্ষয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও সাইক্লোনের তীব্রতা এবং পৌনঃপুনিকতা বৃদ্ধি) ফলে আমাদের নদীগুলো তার আগের চরিত্র বদল করছে। এছাড়াও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে (নদী দখল, অপরিকল্পিতভাবে নদীতে বাঁধ নির্মাণ, সেতু তৈরি, অবৈজ্ঞানিকভাবে বালু উত্তোলন) নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে বাঁধের মাটি বর্ষাকালে বন্যা ও বৃষ্টিতে নদীতে পড়ে নদীকে সংকুচিত করে ফেলেছে।
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) এর তেরোশত নদীর এই বাংলায় বর্তমানে সাতশত নদী ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (তথ্য-বাংলাপিডিয়া)। নদীই কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় কৃষকের প্রাণ। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) নদীকে গৃহলক্ষ্মী ¯্রােতস্বিনী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আবার ফসল রক্ষার সুব্যবস্থা করার জন্য তিনি (শাহ আব্দুল করিম) ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তা কি সম্ভব? বর্তমান অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় কৃষক শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ কতোটুকু সম্ভব? সবুজে ভরা বাগানের উপর ওদের নজর। তাদের চাই বাগানের ফুল ও ফল আর তাতে যদি পুরো গাছটা উপড়ে আসে তাতে কী বা আসে যায়। অনেক সময় এসব মুনাফালোভী মানুষ রাতের আঁধারে স্থায়ী বাঁধ কেটে ফেলে যাতে পরবর্তীতে এখানে প্রকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়। এরকম একটি ঘটনা ঘটে গত কয়েকবছর আগে। জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরে মদনাকান্দি গ্রামের করচ বাগের পশ্চিমে অবস্থিত একটি স্থায়ী বাঁধ রাতের আঁধারে কে বা কারা কেটে দেয়। এখানে যে বাঁধের ক্ষতি হয়েছে তা নয় সাথে এর আশে পাশের ফসলি জমিও নষ্ট হয়ে যায়, যার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অবশ্য হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সর্বদা এসব জনগণের পক্ষাবলম্বন করে মাঠে সক্রিয় থাকলেও তাদের শতভাগ দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রসঙ্গে কবি ইকবাল কাগজী লিখেছেন, “যারা ফল হারা সুনামগঞ্জকে দুর্গত ঘোষণার দাবিতে রাস্তায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে চেয়েছিলেন, তাদের সে দেশপ্রেমের প্রকাশ তার (মহানাগরিক) কাছে সরকার বিরোধিতা বলে মনে হয়েছে। তাই তিনি সেই দেশপ্রেমকে একহাত দেখিয়েই ছেড়েছেন। ফসলহানিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষাবলম্বন তার কাছে একটি অমার্জনীয় অপরাধ হয়ে উঠেছে” দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর, ৩০ জুলাই ২০১৭, পৃষ্ঠা-২৪) এসব মহানাগরিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর (শাহ আব্দুল করিম) সাহসী উচ্চারণ- “তোমার এসব ব্যবহারে অনেকে মানেনা তোমারে / কথায় কথায় তুচ্ছ করে আগের ইজ্জত তোমার নাই / রাখতে চাইলে নিজের মান সমস্যার কর সমাধান / নিজের বিচার নিজেই কর আদালতের দরকার নাই।”
শাহ আব্দুল করিম বাউল শিল্পীদের বাইরে গিয়ে দুঃখের মাঝে জীবনের মুক্তির সন্ধান করেছেন। ভাটি এলাকার মানুষের দুঃখগাঁথা উঠে এসেছে তার গানে- “তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মারমী কবি / আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ দুর্দশার ছবি / বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তির বিধান / মন মজালে ওরে বাইলা গান।” দেশের দুঃখ দুর্দশার ছবি যখন তুলে ধরেন তখন তিনি তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অতীতের কিছু সুখের নমুনা তুলে ধরেন। করিমের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানটি হচ্ছে- “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।”
যে সাধক কবি দুঃখের মাঝে বেড়ে উঠেছেন তিনিই কি না বলছেন তার শৈশব কৈশোরকে সুন্দরকাল। কারণ শত দুঃখ বেদনার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক টুকরো অনাবিল আনন্দ। তখন অধিকাংশ মানুষ ছিল সহজ সরল। গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির আবহের ভিতর তখন গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলাগান ঘাটুগান-এর আসর বসাত। গাজীর গান, সারিগান ও নৌকা বাইচ মানুষের মনে নির্মল আনন্দ যোগাত। হিন্দু বাড়িতে পূর্জা পার্বণ- এ যখন যাত্রাগান হইত তখন মুসলমানও নিমন্ত্রণ পেত। এই যে আনন্দের কথা তিনি বলেছেন তাও কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলের ফসলের উপর নির্ভর করে।
সুনামগঞ্জবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথার পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেছেন এ অঞ্চলের মানুষের শক্ত মনোবলের কথা। বারবার ফসলহানির পর তারা আবার জেগে উঠে ইতিহাসের ফিনিক্স পাখির মত। কৃষি ছাড়া তাদের আর বাঁচার উপায় নাই। করিম বলেন- “ফসল রক্ষা হয় যেভাবে / সেই ব্যবস্থা করতে হবে / খাইতে হবে বাঁচতে হবে / উপায় নাই তো কৃষি ছাড়া।”
উপায় যে নাই তা তো বুঝাই যাচ্ছে। যে হাওরের প্রায় সকল জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল সেখানে কৃষিকে বাঁচানোই তো প্রধান কাজ। বাস্তবতা হলো আমরা সবাই বলছি কৃষিকে বাঁচাতে হবে কিন্তু ধ্বংস করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে তিলে তিলে। এর কারণটা অবশ্য শ্রেণিগত। এখানে জোতদার মহাজন ও ক্ষেতমজুরের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের সম্পর্ক দেখা যায়। ক্ষেতমজুর শোষিত হয়। সে যা উৎপাদন করে তার মূল্যায়নের চেয়ে কম মজুরি পেয়ে। ফলে এই অঞ্চলের অধিকাংশ ক্ষেতমজুর এখন কাজের সন্ধানে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। আবার অধিক মূল্যে বীজ ও অন্যান্য কাঁচামাল ক্রয়, ঋণের কড়া সুদ বা কম মূল্যে শস্য বিক্রয় ইত্যাদি ক্ষুদ্র চাষিদের শোষণের বাহন হিসেবে কাজ করছে। দুঃখ-দুর্দশার হাত থেকে বাঁচার উপায় তাঁর জানা আছে বলেই তিনি বলেন- “আমরা মজুর চাষী/দেশকে যদি ভালবাসী/সবার মুখে ফুটবে হাসি, দুঃখ যাবে দূরে/শোষণ নির্যাতন শুধু শোষক দলে করে/কৃষক-মজুর এক হয়ে যাও রবে না আর অন্ধকারে।” দেশকে ভালোবাসার কথা তিনি বার বার বলেছেন। বাংলা মায়ের মধুর হাসি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। এ দেশেরে গাছে গাছে সুমিষ্ট ফল, মাঠের সোনার ফসল, নদীর সুশীতল জল তাকে আকৃষ্ট করতো। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় করিম আনন্দিত হয়েছেন। যে সকল বীর বাঙালি স্বাধীনতার জন্য শহিদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দেশকে গড়ে তুলতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে- “বাংলা মোদের জন্মভূমি রে বাংলা মোদের দেশ/বাংলা মায়ের সেবা করে হোক না জীবন শেষ।”
আজকাল অনেকেই হাওরবাসীর সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। তারা কিন্তু মাটির কাছাকাছি যেতে পারছেন না। সেই অর্থে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন প্রকৃত মাটির মানুষ। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে থেকেই তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। দুঃখের আসল কারণটি চিহ্নিত করতে পেরেই তিনি দুঃখ জয়ের পথ খুঁজছেন। তাই তিনি তাঁর গানে বার বার কৃষক-মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শাহ আব্দুল করিম বলেন, “ভয় করো না এক হয়ে যাও / মজুর চাষির দল / জুলুম শোষণ দূর করিতে / প্রতিজ্ঞাতে হও অটল।”
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ