এবারও আসছে তীব্র তাপপ্রবাহ, নেই তেমন প্রস্তুতি
- আপলোড সময় : ১২-০২-২০২৫ ০৮:২৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১২-০২-২০২৫ ০৮:২৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
![এবারও আসছে তীব্র তাপপ্রবাহ, নেই তেমন প্রস্তুতি এবারও আসছে তীব্র তাপপ্রবাহ, নেই তেমন প্রস্তুতি](https://sunamkantha.com/public/postimages/67ac076823b8a.jpeg)
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে ছিল রেকর্ড ২৬ দিনের তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহে সারাদেশে প্রাণ যায় অন্তত ১৫ জনের। বিগত সরকার নানান কাজের কথা জানায়। হিট অফিসার নিয়োগ দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পথে পথে ছিটানো হয় পানি। তবে কোনো কিছুতেই কাজের কাজ হয়নি। বরং বাড়তি লোডশেডিংয়ে তীব্র গরমে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সারাদেশের মানুষ।
এবারও একই রকম তাপপ্রবাহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসে স্বাভাবিক তাপমাত্রা সর্বনি¤œ ও সর্বোচ্চ দুটোই বেশি ছিল। রাজধানী ঢাকায় এখন দিনের বেলায় বেশ গরমও অনুভূত হচ্ছে। তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে ঠিক কতটা গরম পড়বে সেটি নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ।
এ অবস্থায় জনগণকে স্বস্তি দিতে কতটা প্রস্তুত অন্তর্বর্তী সরকার? এ নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলছেন, কাজের ফল পেতে সময় লাগবে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বলছেন, বর্ষা মৌসুম এলে গাছ লাগানোর কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করবেন। বিদ্যুতের কোনো সংকট হবে না বলে আশার বাণী শুনিয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
এবার তাপমাত্রা কেমন হবে :
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে গড় তাপমাত্রা শিল্প-পূর্ব সময়ের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তাপমাত্রা নথিভুক্ত করার পর থেকে ২০২৪ সালটি ছিল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। গত বছর পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও সাগরের তাপমাত্রা ১ দশমিক ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস (মেট) বলছে, এল নিনো সক্রিয় থাকার প্রভাব পড়েছে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এল নিনো হ্রাস পেলেও ২০২৫ সাল উষ্ণ হতে চলেছে। এ বছর ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ তিন বছরের মধ্যে একটি হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রবণতা এবং বৈশ্বিক পূর্বাভাস বিবেচনা করে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি গরম পড়তে পারে। তাপপ্রবাহের সংখ্যা এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে পারে যা জনস্বাস্থ্য, কৃষি এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এ বছরও তাপমাত্রা বেশি থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাপমাত্রা ঠিক কোন সময় বেড়ে যাবে, এটা বলা মুশকিল। এ বছর গ্রীষ্মকাল শুরুই হবে গরম দিয়ে। সুতরাং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে তাপপ্রবাহের ধরনও বদলেছে। তাপপ্রবাহ দেরিতে শুরু হচ্ছে। আগে মার্চে হতো। কিন্তু গত বছর এপ্রিলে হয়েছে। দেরিতে হয়ে এটা অনেক দীর্ঘ হয়েছে। গত বছর জুলাই পর্যন্ত তাপপ্রবাহ ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসের স্বাভাবিক সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারির গড় নি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এটি ছিল ১২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি। অন্যদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৪ ডিগ্রি বেশি ছিল। পুরো জানুয়ারি মাসে সারাদেশে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেও দেশের সার্বিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৭ ডিগ্রি বেশি ছিল।
এদিকে আবহাওয়া অফিসের ফেব্রুয়ারি মাসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দিন ও রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি থাকতে পারে। এ মাসের শেষার্ধে দেশের কোথাও কোথাও এক-দুই দিন বজ্রবৃষ্টি ও শিলাসহ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস স্থানীয় আবহাওয়া পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন প্রভাবকের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, এখন তাপমাত্রার একটা ক্রমবর্ধমান প্রবণতা বা রাইজিং ট্রেন্ড চলছে। এটা সারা বিশ্বব্যাপী। ফেব্রুয়ারিতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ এখন কিন্তু শীত মৌসুম। মার্চে তাপমাত্রা আরও বেশি থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ২০২২ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত বছরগুলো উষ্ণতম হিসেবে ধরা হয়েছে। বৈশ্বিক আবহাওয়া অফিসগুলো এমন পূর্বাভাস দিয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখার যে ওয়াদা, সেটা গত বছরই লঙ্ঘন হয়েছে।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসা গ্রিনহাউজ গ্যাস জমা হচ্ছে বায়ুম-লে, যা পৃথিবীকে আরও উষ্ণ করছে। উষ্ণায়নের প্রক্রিয়ায় মানুষের কাজ এবং প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশে দ্রুত নগরায়ণ অন্যতম একটি কারণ। গ্রামেগঞ্জে এখন আর আগের মতো জলাশয় নেই। খাল-বিল ভরাট হচ্ছে। গাছপালা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে শীতল করার উপাদান দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রবিউল আউয়াল বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে এ বছরের তাপমাত্রা বেশি থাকার সম্ভাবনা আমরা দেখেছি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খুব বেশি কোল্ড ওয়েভ ছিল না। যেগুলো ছিল, সেগুলোও স্থায়ী হয়নি। ফলে গরম বেশি অনুভূত হয়েছে। ইউরোপেও হিট ওয়েভ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নগরায়ণের কারণে ও কংক্রিটের ফলে হিট অ্যাবজর্ব হয়ে থাকে। তাপমাত্রা ক্যাপচার হয়ে থাকে। আর এরকম হলে অনেক গরম থাকে। এছাড়া বায়ুদূষণও গরমের অন্যতম কারণ।
বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র, ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এ বছর ওয়ান অব ওয়ার্মার উইন্টার যাচ্ছে। এটা পুরোটা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব। কয়েক বছর ধরে শুধু তিনটা ঋতু দৃশ্যমান হচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পর্যায়ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এবারের তাপপ্রবাহ মোকাবিলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছর তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে সরকার অনেক পরিকল্পনা নিয়েছিল। পরিবেশবিদরা অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের যত সেমিনার, ওয়ার্কশপ হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ে কোনো বাস্তবায়ন নেই। নগর বনায়ন নিয়ে কোনো কাজ নেই। কাচের তৈরি বিল্ডিংয়ের মহামারি চলছে। সব মিলিয়ে আমরা এখনো কোনো আশা দেখছি না।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় ক্ষেত্রগুলো অনেকাংশে দায়ী। বিশেষ করে শহরে সবুজ কমে যাওয়া, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে শহরে দিন দিন কংক্রিটের ভলিউম বেড়ে যাচ্ছে। অথচ রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের নামে পুরো শহরে কংক্রিট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরটাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো পরিকল্পনাবিদের পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এভাবে চললে শহরে কোনোদিন তাপ কমানো যাবে না।
গরমে প্রস্তুতি প্রসঙ্গে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজস¤পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুম আমরা লোডশেডিং মুক্ত রাখতে চেষ্টা করবো। লোডশেডিং মুক্ত মানে এই নয় যে, কোথাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে না। নানান কারণেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে। আমরা চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখবো, যাতে টেকনিক্যাল কোনো কারণ ছাড়া লোডশেডিং না হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ