স্টাফ রিপোর্টার ::
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের চালবন্দ পয়েন্ট। সেখানে তিন রাস্তার মোড়ে একজন কৃষক হাতে কাস্তে ও কাঁধে লাঙল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কৃষাণ চত্বর’। গ্রামবাংলার কৃষি ও কৃষকের ঐতিহ্য তুলে ধরতেই নির্মাণ করা হয়েছিল ভাস্কর্যটি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে এই ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সচেতন ব্যক্তিবর্গ প্রশ্ন তুলেছেন- কেন এই আক্রোশ? কি দোষ করেছিল কৃষাণ চত্বর? বিষয়টি নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যবৃন্দ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত বৃহ¯পতিবার রাতে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের সামনে ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়। শুক্রবার রাতে একদল লোক কৃষাণ চত্বরের থাকা কৃষকের ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই ভাস্কর্য ভাঙার একটি ভিডিও দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন লোক হাতুড়ি দিয়ে ভাস্কর্যটি ভাঙছেন। এ সময় পেছন থেকে স্লোগান দিতে বলা হয়। এরপর ‘শেখ হাসিনার আস্তানা, বাংলাদেশে হবে না’, ‘আওয়ামী লীগের আস্তানা, বাংলাদেশে হবে না’, ‘শাহজালালের তলোয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান দেন সেখানে থাকা লোকজন। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্রশাসন। কৃষাণ চত্বর ভাঙাচুরে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে কৃষিবিদ জালাল উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন- “দোষ করলো কি “কৃষাণ চত্বর”? একজন কৃষক, হাতে কাস্তে, কাঁধে লাঙল - যে লাঙল দিয়ে সে যুগ যুগ ধরে এই বাংলার মাটি চষেছে, যে কাস্তে দিয়ে সে ফসল কেটেছে, যে ঘাম ঝরিয়ে এই মাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে কি অপবিত্র মনে হলো কারও? এই ভাস্কর্য তো কারও বিরুদ্ধে ছিল না, এটা তো কেবল কৃষকের প্রতিচ্ছবি - গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক! তাহলে কেন ভাঙা হলো? কোন অপরাধে রাতের আঁধারে তাকে গুড়িয়ে দেওয়া হলো? তারা বলে, “মূর্তি হারাম, ভাস্কর্য হারাম!” কিন্তু কৃষকের মুখ হারাম হলো কবে? তার কাস্তে, তার লাঙলও কি হারাম হয়ে গেল? আজকে যদি একজন কৃষকের প্রতিমূর্তি ধ্বংস করা যায়, কাল হয়তো সত্যিকারের কৃষকের ঘরও জ্বালিয়ে দেবে তারা! কারণ তারা চায় না, এই মাটিতে স্বপ্ন থাকুক, তারা চায় না, কেউ অতীতের স্মৃতি ধরে রাখুক! কৃষাণ চত্বর ভেঙে দিয়েছে তারা, কিন্তু কৃষকরা ভেঙে পড়বে না! এই মাটিতে যতদিন ফসল জন্মাবে, ততদিন কৃষাণের অস্তিত্বও থাকবে! পাশা শাহীনূর নামে এক তরুণ লিখেছেন, এটা যারা ভেঙেছে তাদের বিরুদ্ধে কি কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম লুঙ্গি কাছা মারা মূর্তি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেবে না! লুঙ্গি কাছা দিয়ে বেটা মানুষ কেন এমন উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে! আচ্ছা সেটা ভেঙে ফেলুন! কিন্তু নামফলক? “কৃষাণ চত্বর” এই লেখাটা কি অপরাধ করেছে? নামফলক ভাঙ্গার যুক্তি কি? এই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে। এই ভাস্কর্য থেকে কয়েকশত মিটার দূরে এখনও প্রতিদিন দিনমজুর কৃষকরা জড়ো হয় ভোরবেলায়। সেখান থেকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে এলাকার বিত্তশালী কৃষকেরা তাদের জমিতে কাজ করার জন্য নিয়ে যায় তাদের। আর সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করেই এই বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিউর রহিম জাদিদ এই চত্বরের নাম দিয়েছিলেন “কৃষাণ চত্বর”! সেই কৃষাণ চত্বর নাম মুছে ফেলার কারণ কি? একটা এলাকার ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার প্রয়াস কাদের এবং এই ঐতিহ্য মুছে ফেলে তারা কি প্রমাণ করতে চায়? যারা ইতিহাস ঐতিহ্য আর ধর্মকে একসাথে গুলিয়ে ফেলে আল্লাহ তাদের সহিহ বুঝ দান করুন, সঠিক শিক্ষা দান করুন।” এদিকে রবিবার সুনামগঞ্জ জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় গ্রামবাংলার কৃষি ও কৃষকের ঐতিহ্য তুলে ধরতে নির্মাণ করা কৃষকের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন অনেক বক্তা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে সকালে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। এতে প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সীমান্তে চোরাচালান, জেলার হাটবাজার, খেয়াঘাট, নদীতে চাঁদাবাজি প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে কৃষকের ভাস্কর্যটি ভাঙার প্রসঙ্গও ওঠে। এ প্রসঙ্গে সভায় পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, এটি দুঃখজনক। এটি নিয়ে কারও কোনো আপত্তি, মতামত থাকলে আমরা সেখানে আরও সুন্দর কিছু করতে পারতাম। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান তিনি। জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, শুধু কৃষকের ভাস্কর্য নয়, অন্য কোনো বিষয়েও যদি কারও কোনো মতভিন্নতা থাকে, তাহলে সেটি আমাদের জানাতে পারেন। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেটি নিয়ে আলোচনা করব। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। এভাবে ভাঙচুর করলে মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক বার্তা যায়, আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে সবার সচেতন থাকা উচিত। অপরদিকে, কৃষকের ভাস্কর্যটি ভাঙচুরকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রোববার রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষকের ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। বিষয়টি এই প্রথম শুনলাম। আমি অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। আর যারা এটা করছে তারা বেকুব ছাড়া আর কিছু নয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কি দোষ করেছিল কৃষাণ চত্বর?
- আপলোড সময় : ১০-০২-২০২৫ ০৮:০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১০-০২-২০২৫ ০৮:৪৭:০৯ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ