বৈষম্য নিরসন, সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধিতা
- আপলোড সময় : ০৮-০২-২০২৫ ১২:৩৩:৫১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০২-২০২৫ ১২:৩৩:৫১ পূর্বাহ্ন

ইকবাল কাগজী
একজন বলেছেন, ‘সমাজে এখনও বৈষম্য বিরাজমান’। তিনি একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ, নাম মোহাম্মদ শিশির মনির। তাকে ধন্যবাদ নিবেদন করছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলকদের সঙ্গে এক বৈঠকে কথা বলার সময় বৈষম্যের কথা বিশেষভাবে প্রচার করার জন্যে। অন্য একজন, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও অর্থনীতিবিদ, আনু মুহাম্মদ বলেছেন, “আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শনের কারণে দেশে বৈষম্য বাড়ছে।” এবং তার অভিমত এই যে, এ দর্শনে নির্ভরশীল কাঠামো রেখে দেশে বৈষম্য কমবে না। বৈষম্য নিয়ে এমন প্রকার কথাবার্তার প্রচারপ্রক্ষেপণ অব্যাহত আছে। অর্থাৎ দেশে সর্বাস্তৃত বৈষম্য নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন এবং সে-বক্তব্যগুলো বক্তার রাজনীতিক অবস্থান বৈষম্য নিরসনের পক্ষে না বিপক্ষে প্রকারান্তরে তা নির্দশ করে দিচ্ছে।
‘সমাজে এখনও বৈষম্য বিদ্যমান’ বাক্যের নিহিতার্থ কী? বাক্যটি কী বার্তা পরিবেশন করে? ‘এখনও বৈষম্য বিদ্যমান’ মানে বৈষম্য অতীতেও ছিল বর্তমানেও আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে থাকবে কি না, এই বাক্যটিতে তার কোনও ইঙ্গিত নেই। ইঙ্গিতটি পাওয়া যায়, বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমনদ্দোজা যখন বলেন, “বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। এখন থেকে সব নাগরিকরা যাতে সমান অধিকার পায়, সেসব বিষয়ে আলোচনা করেছি।” একেবারে সোজা কথায় তিনি বলে দিয়েছেন, কোনও ঘোরপ্যাচ নেই। সুতরাং আলগা করে বুঝিয়ে দেওয়ারও কীছু নেই। তার বক্তব্যের সারার্থের প্রতিফলন আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাঠপর্যায়ের কর্মসূচির সূচিতে। পরিণতিতে বেসরকারি পরিসরের লোকজনদেরকে কেবল ‘সব নাগরিকরা যাতে সমান অধিকার পায়’ তার জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হবে এবং সে-অপেক্ষাটি না করে বোধ করি আপাতত কোনও উপায়ও নেই। তাছাড়া বুঝতে হবে যে, ‘আলোচনা’ ও ‘কর্মসূচি’ কিংবা ‘কর্মসূচির সূচি’ সমান কথা নয়। আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার আগে আলোচনা একটি রীতিসিদ্ধ অনিবার্য নীতি, সেটা মাঠে ফুটবল গড়িয়ে দেওয়ার পর খেলা শুরু হয়ে যাওয়া নয়। কিন্তু এবংবিধ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কোনও না কোনও কর্মসূচি কার্যকর করা নিতান্তই স্বাভাবিক এবং পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, বাস্তবে ইতোমধ্যে তা শুরু করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, “আগে সরকারি হাসপাতালে এক্সরে মেশিন ছিল না। আমরা এ নিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি, এখন এক্সরে মেশিন চালু করা হয়েছে। নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন। শিশির মনির ভাই বলেছেন, একটা মেডিকেল টিম গঠন করার জন্য। আমরা জানিয়েছি, অলরেডি আমাদের একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।”
বৈষম্যবিরোধী উপরোক্ত কর্মসূচি চলার পাশাপাশি সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী জুলাই গণঅভ্যুত্থানোত্তর দেশের রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পরিসরে সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বৈষম্যের কথা অধিক মাত্রায় প্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শিকতা থেকে প্রচার করা ‘সব নাগরিকের সমান অধিকার’-এর প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু বৈষম্য উদ্ভবের মূল কারণ নির্মূলের রাজনীতি থেকে সরে থাকা হচ্ছে সচেতনভাবেই কিংবা হতে পারে নিজের অজান্তেই। এমনটা (অর্থাৎ বৈষম্য উদ্ভবের মূল কারণ নির্মূলের রাজনীতি থেকে সরে থাকা) যদি অজান্তেই হয়ে থাকে তা হলে এ ক্ষেত্রে জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, বৈষম্যের মূল কারণ হলো বর্তমান শোষণনির্ভর আর্থসামাজিক বিন্যাস কাঠামো। অর্থাৎ নয়া ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্যের পদতলে আত্মসমর্পণকৃত আর্থনীতিক ও রাজনীতিক নীতি। এই নীতির কারণেই বৈষম্যবিরোধিতার সফলতা স্বরূপ রাষ্ট্রক্ষমতায় মূলত বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শে অনুপ্রাণিতরা অধিষ্ঠিত নয় বা হতে পারেন নি। এটাই দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিক বাস্তবতা। এই কারণেই বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শিক ভাষ্যে বৈষম্যের প্রসঙ্গ যতোটা প্রকাশ্যে আসে এর কারণ নির্মূলের কথা ততোটাই আড়ালে পর্যবসিত হয়। বৈষম্যের মূল কারণ পুঁজির প্রভুত্বের বিরুদ্ধে কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমশোষণের বিরোধিতার রাজনীতি করা সহজে সম্ভব হয়ে উঠে না। যেমন আনু মুহাম্মদের পক্ষে সম্ভব হয়। তিনি দেশের আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোর নিয়ন্ত্রণকে স্বদেশি করে তুলতে চান এবং বৈষম্য সৃষ্টির কারণকে দেশে ‘আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শন’ অনুসরণকে নির্দেশ করেন। এই ‘আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শন’ বলতে আনু মুহাম্মদ কী বুঝাতে চেয়েছেন? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং এর উত্তর সন্ধানে নেমে কেউ হয়তো বলে দেবেন যে, তিনি ‘আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শন’ বলতে ‘নয়া ঔপনিবেশিক আধিপত্যের আর্থনীতিক নীতি’ কিংবা ‘সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রয়োগের নীতি’কে বুঝাতে চেয়েছেন। এদিক থেকে বিবেচনায় বলতেই হয় যে, নয়া ঔপনিবেশিক দাসত্বের জোয়াল দেশের কাঁধে ইতোমধ্যে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, কেউ কেউ এই জোয়ালের গুরুভার বইতে অস্বীকার করছেন না এবং কেউ কেউ করছেন। এমতাবস্থায় আনু মুহাম্মদের এই বক্তব্যের কিঞ্চিৎ সম্প্রসারণ হিসেবে আরও স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয় যে, উৎপাদনী উপায়ের মালিক শ্রেণি কর্তৃক অপরের শ্রমফল আত্মসাৎ করার অর্থনীতিকে কিংবা আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোকে উৎখাত করতে না পারলে বৈষম্য নিরসন কোনওভাবেই এবং কোনও দিনই সম্ভব নয়।
উক্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “মেডিকেলে অনিয়ম দুর্নীতি হয়, এগুলো তদারকি করা হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে আমাদের টিম খোঁজখবর রাখবে, সেখানে সঠিক ভাবে কাজ হচ্ছে কি না, তারা নিয়মিত দেখভাল করবে, খোঁজ নিবে।” আপাতত মনে হতে পারে এর চেয়ে উত্তম আর কীছু হতে পারে না এবং এমনটাই হওয়া উচিত, এর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত আর্থসামাজিক বিন্যাসব্যবস্থা বা কাঠামোরূপ যে-যন্ত্রদানবটা প্রতিনিয়িত নতুন নতুন অনিয়ম-দুর্নীতি কেবল প্রসব করেই চলবে তার কী হবে, সে-আর্থনীতিক দুর্বৃত্তটার রাজনীতির লাগাম টানবে কে? যে-লাগামটা ইতোমধ্যে ‘আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শন’ আখ্যায় অভিহিত হয়ে দেশের আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোকে বিদেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল করে তোলে দেশের ভেতরে অবিরাম বৈষম্য বাড়িয়ে চলেছে।
এই যে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আছে এবং বোধ করি থাকবে আরও কীছু কাল, এই প্রসঙ্গটাও বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, তা-না হলে এই জনবান্ধব আন্দোলন-বিরোধিতার সাফল্য ভোগ করবে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী কোনও না কোন শক্তি ও তার দেশীয় তল্পিবাহকেরা। এটাও একটা রাজনীতি। যে-রাজনীতি ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শকে চিরদিনের জন্যে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানোর বেগার খাটা অথবা দেশপ্রেমের রসায়নে জারিত অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানোর অমলধবল চাকরি দিয়ে দেওয়ার মতো মহার্ঘ্য একটা কীছুর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে এবং অপরদিকে নিজে আরও আরও খতরনাক অনিয়ম-দুর্নীতি করবেই, তার প্রস্তুতি চালিয়েই যাচ্ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বিষয়টা অনেকটা পৌরসভার রাস্তাঘাটে মলবর্জ্য জমার মতো, পরিচ্ছন্নতাকর্মী সেটা পরিষ্কার করার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে, কুচপরোয়া নেই। চমৎকারিত্ব আর কাকে বলে। যে-চমৎকারিত্বের গুণে যতোসব ‘অনিয়ম দুর্নীতি হয়’-এর ‘তদারকি’ এবং ‘সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কি না’ তার ‘নিয়মিত দেখভাল করা’, ‘খোঁজ’ নেওয়া কোনও দিনই ফুরাবে না এবং বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কর্তব্যপরায়ণতা হয়েই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবেন এবং বৈষম্য উৎপাদনে ভীষণ ভীষণ উর্বর বিদ্যমান আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোটি বদলে গিয়ে বৈষম্য উৎপাদনে কোনওদিনই নিরুৎসাহিত হবে না। আনু মুহাম্মদ উপরে উল্লেখিত তাঁর বক্তব্যে ‘বৈষম্য উৎপাদনে ভীষণ ভীষণ উর্বর বিদ্যমান আর্থসামাজিক বিন্যাস কাঠামোটি’কেই সংক্ষেপে কেবল কাঠামো বলে অভিহিত করেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই এবং বলেছেন, সেটি দেশের ভেতরে ক্রমাগত বৈষম্য সৃজনে পারঙ্গম বিদেশি শক্তির করতলগত হয়ে আছে।
বৈষম্যবিরোধিতার আদর্শিকতার বিবেচনায় অনিয়ম-দুর্নীতি নিরসনের কর্মসূচি অপরিহার্য বটে। সেটা দেশজুড়ে বিস্তর কাজের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু জনকল্যাণমূলক এই প্রয়াস কি অনিয়ম-দুর্নীতি দেশ থেকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে? প্রশ্ন থেকেই যায়। আর যদি নির্মূল না হয় তবে বৈষম্যবিরোধী এই মহৎ আদর্শিক কার্যক্রম পৌসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজের চেয়ে বেশি মর্যাদা পাবে বলে মনে হয় না, মোটাদাগে বড়জোর সংস্কার আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করবে। ভুলে গেলে চলবে না সংস্কার কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মতো ধ্বংসস্তূপের উপরে নির্মিত নতুন কোনও স্থাপনা নয়। তাছাড়া সংস্কার একটি উত্তম কর্মসূচি বটে, কিন্তু ‘সব নাগরিকের সমান অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে আদপেই কোনও ভূমিকা রাখার রাজনীতিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও কর্মসূচি নয়। ‘সব নাগরিকের সমান অধিকার’-এর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধিতার একটি সম্পর্ক আছে। সুতরাং বৈষম্যবিরোধিতাকে কোনও না কোনওভাবে সমাজ প্রগতির ধারণার সঙ্গে সমন্বিত হওয়া চাই। প্রগতি অর্থে মেরামতির মতো নিছক পরিবর্তন নয়, বরং নি¤œতর অবস্থা থেকে উচ্চতর অবস্থার দিকে গতি। সংস্কার বা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার মধ্যে একটি আদর্শিক সৌম্যতা আছে বটে কিন্তু তাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি নেই। তেকারণে আসলে বৈষম্যবিরোধিতাকে গতি দিতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ