সুনামগঞ্জ , শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
খেলাফত মজলিসের জেলা কমিটি গঠন গণশিক্ষা উপদেষ্টার সাথে সুবিপ্রবি স্থায়ী ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির সাক্ষাৎ বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি আর জ্ঞানের প্রতীক- জেলা প্রশাসক ২০১৮ সালে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা ৩৩ ডিসিকে ওএসডি বিএনপির বর্ধিত সভা এবার সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের পরিকল্পনা সভা আল-আকসা কিন্ডারগার্টেন উদ্বোধন সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসনাত কাওসার গ্রেফতার শিক্ষকের মারধরে ছাত্র আহত অ্যাড. নূরুল ইসলামের সমর্থনে প্রচার সভা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসির উদ্যোগে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ এখনো অনেক কাজ বাকি এবারও হাওরের মাটি কাটা হচ্ছে কলমে! জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন জগন্নাথপুরে ৩ দোকান থেকে নগদ অর্থসহ অর্ধকোটি টাকার মোবাইল চুরি মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টোল আদায় বন্ধের দাবি জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাণীগঞ্জ মাদ্রাসায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে অত্যাধুনিক এক্স-রে মেশিন চালু : স্বল্প মূল্যে সেবা পাবেন রোগীরা ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে মাদ্রাসা সুপারের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ

জ্যোতির্ময় জননায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

  • আপলোড সময় : ০৬-০২-২০২৫ ১২:২৭:৪৫ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৬-০২-২০২৫ ১০:১২:৫৬ পূর্বাহ্ন
জ্যোতির্ময় জননায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
মুক্তাদির আহমদ মুক্তা::
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উত্থান যেমন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তেমনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতি টানতে হয়েছে চরম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, যেমন চরম প্রতিক্রিয়াশীল অপরাজনীতি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত চেহারা নিয়ে। তেমনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও সাম্প্রদায়িকতা, কূপম-ুকতা, ষড়যন্ত্র আর গোষ্ঠীতন্ত্র মোকাবিলা করে রাজনীতি করতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ছোট দলের বড় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শচ্যুত হননি। আত্ম মনোবলে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন “কোটায় মন্ত্রী হতে চাইলে বহু আগেই মন্ত্রী হতে পারতাম। শেষ ট্রেনের যাত্রী আমি।” বাংলাদেশের উন্মেষ, বিকাশ ও সংসদীয় রাজনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের যথাযথ চিত্র ফুটে উঠে আপন মহিমায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনীতির যেন এক রূপান্তরের চিত্র। বৈচিত্র্যময় দলিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ যার জন্য বাংলাদেশে প্রথম বিভিন্ন পদ সৃজন করা হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাঁকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছিল। এর আগে এমন পদে কাউকে আসিন হতে দেখা যায়নি। ২০১১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ভেঙে নতুন রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়টির প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে তিনিই প্রথম দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পারিবারিক তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে। অবশ্য তাঁর পাসপোর্টে জন্ম সাল ১৯৪৫ সালের ৫ মে এবং জাতীয় সংসদে থাকা সংসদ সদস্যদের জীবন বৃত্তান্তে ১৯৪৬ সাল লেখা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ¯œাতকোত্তর করে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন সুরঞ্জিত। পরে কিছুদিন আইন পেশায় যুক্তও ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুররু করেন। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই ভাগ হলে সুরঞ্জিত সেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-২ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৫ নম্বর সাব সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুস সামাদ আজাদের কাছে পরাজিত হন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদে তিনি একতা পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় ও ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদে তিনি গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত সুরঞ্জিত আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-২ আসনে হেরে গিয়েছিলেন। পরে হবিগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। পরবর্তীতে ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে তিনি সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মারা যান। অবসান হয় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে যিনি ছিলেন উচ্চকিত তাঁকেও ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতির কবলে পড়ে হতে হয়েছে বিতর্কিত, সমালোচিত। নিখাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য তাঁর ছিল দীর্ঘ লড়াই। রাজনীতিটা যেন রাজনীতিবিদের হাতে থাকে এজন্য দলের ভেতরে, বাইরে তিনি সোচ্চার থাকতেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের গণজোয়ারের মধ্যে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বর্তমানে যখন সংবিধানের পুনর্লিখন, সংশোধন, পরিমার্জন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা - সমালোচনা হয় তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভূত হয়। গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সংবিধান সভার তাঁর বক্তব্যগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা পড়ে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি ও দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি থেকে প্রতিটি সরকার যখন বিচ্যুত হয়েছে তখন তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। নিজেকে সংস্কারবাদী আখ্যায়িত করে ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য বিভিন্ন ফোরামে তিনি যে বক্তব্যগুলো রেখেছিলেন তাই যেন এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির উদ্দেশ্যে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন সেখানে দেশের ভবিষ্যত গণতন্ত্র নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন। বিএনপিকে সংবিধান সংশোধন কমিটিতে অংশগ্রহণ করে আলোচনা বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অক্ষুণœ রাখার পক্ষে আদালতে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যেন সে পথেই হাঁটতে থাকে। বার বার দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা বাধাগ্রস্ত, সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত, রাজনীতি কলুষিত হওয়ার কথা তিনি উচ্চারণ করতেন ভগ্ন হৃদয়ে, দূরদর্শী চিন্তা থেকে। ব্যক্তিগত সহকারীর কেলেংকারীতে পড়ে তিনি বাংলাদেশে প্রথম ব্যক্তি যিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন তদন্তকারী সংস্থা কর্তৃক নির্দোষ প্রমাণিত না হলে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন না। পরে তাই করেছিলেন। সরকারের অংশ হয়েও তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। দল ও সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। নিজেই উচ্চারণ করেছিলেন “সারা জীবন রাজনীতি করে কেবল বন্ধু নয়, অনেক শত্রুও তো সৃষ্টি করেছি।” ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের মতো তিনিও সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে দলের ভেতরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করা, যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, দলের প্রধান হলে সরকার প্রধান না হওয়া এমনসব প্রস্তাব গণমাধ্যমে তুলে ধরে তিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা হারান। কর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েন। এরজন্য তাকে রাজনৈতিকভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ২০১২/১৩ সালে শেয়ার বাজার কেলেংকারি যখন তুমুল আলোচনায়। শেয়ার বাজারে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসা বিনিয়োগকারীদের যখন হাহাকার চলছে। সেই সময় এসব কেলেংকারির সঙ্গে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাকেই যখন শেয়ার বাজার তদারকিতে বসানো হয় তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “শুঁটকির বাজারে আজ বিড়াল চৌকিদার।” আজকে যখন “দরবেশ” নাম নিয়ে অনেক নব্য বিপ্লবী তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। তখন হয়তো তারা ভুলে যান এই “দরবেশ” নামটিও ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দেওয়া খেতাব। দল করে দলের বিভিন্ন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের সমালোচনা করা আবার দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে দলের নেতৃত্বের প্রতি অবিচল থাকা এসব সুরঞ্জিত চরিত্রের ছিল বড় গুণ। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনায় মুখর থাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রথম বারের মতো রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলে বলেছিলেন, রেলের কালো বিড়াল বের করাই তাঁর প্রথম কাজ। তাঁর মন্ত্রীত্ব ও ক্ষমতা অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ হয় এবং কিছু দিনের মধ্যে তাঁর মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত সহকারীর আর্থিক কেলেংকারির কারণে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দলীয় ফোরামে যে অপ্রিয় কথাগুলো বলতেন তা যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আমলে নিতেন তা হলে আজ দলের এমন করুণ পরিণতি হতো না। দলের ভেতর আমলাতন্ত্রের প্রভাব বিস্তার, ব্যবসায়ীদের আধিপত্য, দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে অযোগ্যদের প্রাধান্য ও সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে তিনি নানা সময় প্রশ্ন তুলেছেন। “এমপি কি কেছকি মাছের ভাগা” এমন সব বক্রোক্তি করে তিনি রাজনীতির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেন। দেশের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় যে প্রশ্ন তুলতেন তাই যেন আজ নিষ্ঠুরভাবে বাস্তব হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বভাবসুলভ রসবোধ আর যুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতায় তিনি পৌঁছেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি ছিলেন সত্যিকারের মাটি ও মানুষের নেতা। মানুষের মনের ভাষা তিনি পড়তে পারতেন। মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল যেন তাঁর প্রশান্তি। রাজনৈতিক সকল সংকটে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি প্রথাবিরোধী হুংকার দিতেন আপন মহিমায়। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন ও গণতন্ত্র বিকাশে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চায়, সরকারের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্যে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন পড়াশোনা করা রাজনীতিবিদ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এই নন্দিত পার্লামেন্টারিয়ানের সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বক্তব্য, বিবৃতিতে তিনি প্রায়শই কবিতার পংক্তি ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষা রপ্ত করা, সাহিত্যের রসবোধ আর প্রখর মানবিক মূল্যবোধ স¤পন্ন জননেতা ছিলেন তিনি। তেজ ও নাটকীয়তায় ভরা বক্তব্যে তিনি সংসদ থেকে জনসভা সর্বত্র মুগ্ধতা ছড়াতেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্র আর উল্টো¯্রােতে সাঁতার কেটে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংগ্রামী। স্বভাবসুলভ বিপ্লবী। অমিত সাহস নিয়ে কথা বলতেন যুক্তিপূর্ণ মুক্তচিন্তায়। হাস্যরসাত্মকভাবে সহজ ভাষায় কঠিন আক্রমণ করতেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। শিল্পিত প্রকাশে ঘায়েল করতেন বিরোধীপক্ষকে। সরকারি দল, বিরোধীদল সব অবস্থানেই তিনি মন্ত্রী, আমলাদের বিরুদ্ধে টিপ্পনি কাটতেন। অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়িত হলেও কষ্ট চেপে রাখতেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত সহকারীর আর্থিক কেলেংকারিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। প্রশাসন ও মিডিয়ার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সংবাদ মাধ্যমে তাকে জড়িয়ে কাল্পনিক প্রতিবেদনে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন। তদন্তের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসেন অমিত সাহসে। তবু যেন অনেকটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরইমধ্যে ধীরে ধীরে অসুস্থতা কাবু করে ফেলে। তবুও অসুস্থ শরীরে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব আর দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সংকট আর সম্ভাবনার কথা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো তারকা। মাটি আর মানুষের রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জননন্দিত কর্মীবান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় উঠেছিলেন রাজনীতির কবি এবং জাতীয় নেতা। নিজস্ব বর্ণনা ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় জননেতা। জাতীয় সংসদে, সংবাদ সম্মেলনে, রাজনৈতিক জনসভায় তিনি কথা বললে জনতা হাসতেন, কাঁদতেন, জাগতেন। আমুদে ও সদালাপী সুরঞ্জিত ছিলেন দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি-বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন আশা আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক। দেশ ও জাতির বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে একজন সাহসী সুরঞ্জিত সেনের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদে তিনি তাঁর প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তব্যে, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংকটের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই যেন আজ বাস্তব হল। দেশের রাজনীতিতে অনেক পটপরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই পুরনো বক্তব্যগুলো প্রাসঙ্গিকভাবে অবিনাশী বাণী হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অষ্টম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। চিরপ্রশান্তিতে থাকুন হে সংগ্রামী জননেতা।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক কর্মী।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
গণশিক্ষা উপদেষ্টার সাথে সুবিপ্রবি স্থায়ী ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির সাক্ষাৎ

গণশিক্ষা উপদেষ্টার সাথে সুবিপ্রবি স্থায়ী ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির সাক্ষাৎ