গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে এবং এই পালাবদলকে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করে একজন চিন্তক ফরহাদ মজহার এটিকে (ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে) তার (ফরাসি বিপ্লবের) চেয়েও হাজার গুণে কঠিন বলে বর্ণনা করেছেন। সে-ব্যাপারে বিস্তারিত বলার অবকাশ আপাতত এখানে নেই। এই গণ-অভ্যুত্থান দেশকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে সেটাও আপাতত এখানে বিশ্লেষণ করছি না, সেটার জন্যে অপেক্ষায় আছি এবং এখানে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের অর্থাৎ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন কিংবা ক্ষমতার পালাবদলের পর ক্রমে ক্রমে দেশে লুটপাট আর দখলের অপসংস্কৃতির যে-কদর্য রূপের প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে অবাক হচ্ছি না বটে, জানতাম এমনটাই হবে, কিন্তু তার প্রকারপ্রকরণ আর বহর যে এতোটা বিরাট ও ভয়ঙ্কর হবে তা কল্পনারও বাইরে ছিল। ভাবা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বছর কয়েকের ব্যবধানে এক একজন ক্ষমতাসীনের (মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, আমলা, ব্যবসায়ীর) আয় বেড়েছে লক্ষগুণেরও বেশি।
আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কথা প্রবাদপ্রবচনে বলা আছে, তার বাস্তব রূপ প্রত্যক্ষ করতে হলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সম্পদের পাহাড় গড়ার বাস্তবতাকে চাক্ষুস করা চাই। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর উত্তরপাড়ের বালু-পাথর যেমন লুটপাট হয়েছে তেমনি লুটপাট হয়েছে দেশের ব্যাংকগুলো, তেমনি দখল হয়েছে বন, পাহাড়, নদী, মাঠ, চর, বাড়ি, জমি এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইত্যাদি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দেশের সমগ্র বাজার, আধিপত্যের জালবিস্তার করে। এমন কি মানুষের মগজ পর্যন্ত তারা দখল করে নিয়েছে। এবংবিধ লুটপাটের বিস্তৃতি ও ধরণ পরিলক্ষিত করে যে কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, আমাদের সম্পাদকীয় দপ্তরও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই সম্পাদকীয় দপ্তরের প্রশ্ন এই যে, আমাদের সামষ্টিক চেতনায় কি লুটপাটের অপসংস্কৃতি প্রোথিত রয়েছে? এর উত্তরে আমরা নির্দ্বিধায় বলি যে, অবশ্যই নয়। সামষ্টিক চেতনায় লুটপাটের অপসংস্কৃতি প্রোথিত নেই, বরং অর্থনীতির প্রভাবে মানুষের চেতনায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে মাত্র এবং সে-অপসংস্কৃতিটা প্রোথিত আছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মর্মে। আমরা এর জন্য দায়ী করি বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সমাজসংস্থিতিকে অর্থাৎ সামাজিক-আর্থনীতিক গঠনরূপকে, যে-গঠনরূপটির নাম পুঁজিবাদ, এর ভিত্তি হলো উৎপাদনের উপায়ের উপরে ব্যক্তিগত পুঁজিতান্ত্রিক মালিকানা ও মজুরি শ্রম শোষণ। সমাজে এই শোষণ বজায় থাকলে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানস্তরে চোর-বাটপার-তঞ্চকের সংখ্যা বাড়তেই পারে এবং তারা সমাজ-শাসনের রজ্ঝু হাতে নিয়ে লুটপাট ও আত্মসাতের সা¤্রাজ্য গড়ে তোলতেই পারে, একেই বলে রাজনীতি, ভুলে গেলে চলবে না, অর্থনীতির ঘনীভূত রূপই প্রকারান্তরে রাজনীতি নামে অভিহিত। এই রাজনীতিটাকে বদলে দিতে হলে আগে অর্থনীতিটাকে শোষণহীনতায় কিংবা বৈষম্যহীনতায়, আরও মূর্তনির্দিষ্ট অর্থে আর্থনীতিক সাম্যের অভিমুখে বদলে দিতে হবে। একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে একজন ২০ হাজার তো অন্যজন ৮০ হাজারের আকাশ-পাতাল ব্যধানের বেতন পাবে, এমন হতে পারে না। এই সামাজিক বাস্তবতাটিকে বদলে দিতেই হবে। তা না হলে বার বার ছাত্র-জনতাকে সরকার পতনের দাবি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মতো অন্যকোনও নামের আন্দোলনে উদ্যোগী হয়ে রাস্তায় নামতে হবে।