সুখেন্দু সেন::
মৃত্যু এক অমোঘ বিধান, কঠিন সত্য। জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন এর আকস্মিক এবং অকাল প্রয়াণ আমদেরকে নিরুপায় সেই নির্মম, নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিলো। আনোয়ার হোসেনের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশী দিনের নয়। তবুও আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যের এক আস্তরণ আমাদের পারস্পরিক ¯েœহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার সম্পর্ককে অনেকখানি শক্তপোক্ত করে দিয়েছিলো। আনোয়ার হোসেনের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন এর সাথে দীর্ঘদিনের জানাশোনা থাকলেও জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করেই মূলত তাঁর সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। তিনি বেশ ক’বছর ধরে লাইব্রেরীর নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আমিও এই কমিটির সহ-সভাপতি থাকায় ক্রমে আমাদের মাঝে এক সহযোগী সুলভ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা পরে আর কেবল লাইব্রেরি কেন্দ্রিক থাকে নি। তাঁর অমায়িক ব্যবহার, সদাহাস্যময় মুখম-ল, শ্রদ্ধাবোধ এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে অল্পতেই তাঁর প্রতি একটা প্রগাঢ় মমত্ববোধ ক্রমে দানা বাধে। ২০২২ সালে জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির পক্ষ থেকে একুশের বই মেলায় ঢাকা যেতে তিনি আমার সঙ্গী হলেন। সঙ্গী না বলে বলা যায় উনার সযতœ তত্ত্বাবধানেই আমার তিনদিন দুই রাত্রির ঢাকা বাস। হোটেল ঠিক করা, রিকসা নেয়া, কোন রেস্টুরেন্টে কী খাওয়া, কোথায় কেনাকাটা করা সব দায়িত্বই আনোয়ার হোসেন নিজের কাঁধে তুলে আমাকে নির্ভার করে রাখলেন। দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের এমন পরাকাষ্ঠা দেখা যায় না সচরাচর। বই মেলায় বই দেখছি, বই কিনছি। হঠাৎ পাওয়া গেলো মাহবুবুল হাছান শাহীনকে। বই কিনে গাঁট বাঁধা হচ্ছে। সে গাঁটগুলিও আমাকে ধরতে দেয়া হলো না। ধরতে গেলেই, আমরা কী জন্য আছি বলে দু’জনে মিলে টেনেটুনে এগুলি গুছিয়ে নিতেন। সেবার মেলায় অস্তিত্ব প্রকাশনী থেকে আমার একটি কবিতার বই বের হয়েছিলো। আনোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে অস্তিত্বের স্টলে ছোটখাটো একটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানও হয়ে গেলো। শুধু তাই নয় “স্থির হয়ে আছে” নামে সে কবিতার বইটির প্রথম ক্রেতা ছিলেন আনোয়ার হোসেন। সৌজন্য কপি না নিয়ে স্টলে নগদ টাকা দিয়ে তিনি অত্যন্ত গর্বভরে সে বইটি কিনে নিয়েছিলেন। মেলা থেকে বেরিয়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরি। বলাবাহুল্য নিষ্ঠাবান গাইড আনোয়ার হোসেন। এক জায়গায় কোটের পসরা সাজিয়ে ফুটপাতের দোকান। আমাকে দেখিয়ে বললেন - উকিল সাহেবরা অনেকেই এখান থেকে কোট কেনেন। আমারও আগ্রহ হলো। এটা সেটা দেখছি। হ্যাঙ্গারে ঝুলানো কোটগুলি তেমন গা সই হলো না। আনোয়ার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। বিক্রেতাও ঢাকাইয়া চোখ দিয়ে ক্রেতার মনোভাব নিরীক্ষণ করছেন। হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে দোকানী বললো- এইগুলান রাখেন। আপনারে আসলটা দিতাসি। নিচে পলিথিনে ঢাকা অনেকগুলো ভাঁজ করা কোট খুলে একটা আমার সামনে মেলে ধরলো। ভাবসাব এমন যে, এটি কেবল আমার জন্যই অনেক যতœ করে আগলে রাখা। ঠিকইতো। একদম খাপে খাপ। এবার আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে দ্রুত এগিয়ে এসে আনোয়ার হোসেন বললেন- কতো দেবো। বারোশো টাকা বিক্রি করি। আপনার জন্য একহাজার। আমাকে অবাক করে দিয়ে ততোধিক নিস্পৃহভাবে আনোয়ার তিন আঙ্গুল সামনে তুলে - তিনশো টাকা। তাচ্ছিল্য ভরে দোকানদারের প্রশ্নসূচক জবাব, তিনশো টাকায় কোট হয়? গেঞ্জিওতো হয় না। তা হলে থাক, রেখে দাও। আমার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে উদ্ধত হলে দোকানদারের ভাবান্তর ঘটলো। পাঁচশো টাকা দেন স্যার। আমি আস্তে আস্তে বলি, নিয়ে নেই। আরে থামেন তো দাদা- বলে দোকানদারের প্রতি দূর থেকেই হাত নাড়িয়ে স্পষ্ট ও শেষ জবাব- না না। এবার পেছন থেকে দোকানির হাঁক। নিয়ে যান স্যার। তিনশো টাকাই সই। বাড়ি ফিরে লন্ড্রিতে ধোলাই দিয়ে সে বছর চুটিয়ে কোটটি পরেছি। হোটেলে রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়ি সাড়ে ন’টার ভেতরই সেরে ফেলা হয়। সেদিন খাবার শেষে তাঁর এক বন্ধুকে পেয়ে কোথায় যেনো ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন। রুমে একা শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে মেলা থেকে নিজের জন্য কেনা ক’টি বই খুলে দেখছি। সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরে এসে বললেন- দাদা, এখানে খুব ভালো দুধ পাওয়া যায়। আমি খেয়ে এসেছি। ঢাকা আসলে প্রতিবারই খেয়ে যাই। আপনাকেও খেতে হবে। সে কী। রাত বারোটায় এখন দুধ খাবো। পরে কী না কী হয়। সেতো নাছোড়বান্দা। কী আর করা। গায়ে সার্ট চাপিয়ে বের হলাম। ফকিরাপুলের এগলি - সেগলি ঘুরে একজায়গায় দেখলাম এক দুধওয়ালী মধ্যরাতেও দুধের দোকান বেশ জমিয়ে রেখেছে। একটি চুলায় দুধ জাল হচ্ছে। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে দুধ খাচ্ছে। কেউ আবার গ্লাস ভর্তি গরম দুধ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও গরম দুধের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি আর তৃপ্তির হাসি দেখছি আনোয়ার হোসেনের চোখে মুখে। যেনো একটা পুণ্যের কাজ আমরা সম্পন্ন করছি, এমনই ভাব। এই তো সেদিন একসাথে লাইব্রেরির নির্বাচন করলাম। কী আনন্দ আর উৎসবমুখর পরিবেশ। ভোটাররা আসছেন। প্রার্থীরা একই সঙ্গে গিয়ে তাঁদেরকে ঘিরে ধরছেন। আনোয়ার হোসেনও এদিক সেদিক ছুটছেন। ভোটারদের সাথে আলাপ করছেন তাঁর সেই সহজ সরল হাসি মুখে। নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। চলে গেলেন নেপাল ঘুরতে। ভ্রমণের ঝোঁকও ছিলো। বেশ কিছুদিন ইংল্যান্ডে ছিলেন। প্রায়ই শিলং, কোলকাতা ঘুরতে যেতেন। নেপাল থেকে ফিরে এসে সেই প্রাণবন্ত মানুষটি পাঁচ জানুয়ারি যোগ দিলেন লাইব্রেরির নূতন নির্বাহী কমিটির সভায়। এরপর আবারও দেখা সম্ভবত বৃহ¯পতিবার। ১১ জানুয়ারি, শনিবার রাতে খলিল রহমানের ফেসবুক পোস্ট, আনোয়ার হোসেন আর নেই। পোস্টে এখনও জাস্ট নাও মার্ক করা রয়েছে। হৃদপি-ের একটা বিট যেনো মিস করলো। বিশ্বাস করতে পারছি না। কোন আনোয়ার? নাহ, পোস্টের সাথে ছবিও আছে। মুখে তার চিরচেনা সরল হাসির রেখাটি কী অমলিন। আনোয়ার হোসেন চলে গেলেন, লন্ডন নয়, নেপাল নয়, শিলং নয়- আরো কত যোজন যোজন দূরে, যেখানে গেলে আর ফেরা হয় না কারোরই। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে জীবনে অন্তরে কী ধারণ করলে মুখজুড়ে এমন এক সরল নিষ্পাপ হাসি চিরসঙ্গী হয়ে রয় তা জানা নেই। কিন্তু আনোয়ার হোসেনের জন্য আমাদের অন্তরের বেদনাবোধ যেনো স্থায়ী হয়ে রইলো। আজ সন্ধ্যায় জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির পক্ষ থেকে শোকসভার আয়োজন করা হয়েছে। যেতে হবে। ঢাকা থেকে আনোয়ার হোসেনের কিনে দেয়া কোটটির কথা হঠাৎ মনে পড়লো। গত দু’বছর সেটি আর গায়ে চাপানো হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পেলাম। কুঁচকে আছে। ন্যাফতালিনের ঘ্রাণের সাথে একটা মায়া মাখা ঘ্রাণ যেনো জড়িয়ে রয়েছে। কোটের সোলডার ধরে ঝারছি। কিছু চূর্ণ স্মৃতি ঝরে পড়লো। ঢাকার বই মেলা, গুলিস্তান ফুটপাতের দোকান, গরম দুধের গ্লাস, আনোয়ার হোসেনের তৃপ্ত হাসিমাখা মুখ...। সেই কোট চাপিয়ে আমি চলছি শোকসভায়। আনোয়ার হোসেনের আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
আনোয়ার হোসেন মায়াবী স্মৃতির দর্পণে
- আপলোড সময় : ১৬-০১-২০২৫ ০৮:০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-০১-২০২৫ ০৯:০৩:২৫ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ