1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৫:৩৫ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

জয়তু জননী

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩১ মে, ২০২১

:: গৌরী ভট্টাচার্য্য ::
১৯৮২ সাল। সুনামগঞ্জ তখন মহকুমা শহর। আমার জীবনসঙ্গীর কর্মস্থল হিসেবে আমার সুনামগঞ্জ আসা। এই বসবাসের সূত্র ধরে অনেকের সাথে চেনা-জানা। ভাড়া বাসায় নতুনপাড়াতে প্রথম উঠি। মেয়েটির জন্মের পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। মায়ের কাছে চলে যাই। ওখানে মাস ছয়েক থাকার পর নতুন বাসা, ষোলঘর মহিলা সমিতির পেছনে (বর্তমানে উকিলপাড়া)। এলাম নতুন ভাড়াটিয়া হিসাবে।
শ্রাবণ মাস। অঝোরে বৃষ্টি। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারের মধ্যে দুটি শিশুকে নিয়ে রাত প্রায় দশটায় এসে প্রবেশ করেছি নতুন ঠিকানায়। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি আর অন্ধকারে হারিকেন জ্বালিয়ে ছুটে এলেন দু’জন মাঝ বয়সী নারী-পুরুষ। হাসি দিয়ে বললেন, “এসো, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।” হারিকেনের ক্ষিণ আলোয় স্নেহ মমতায় ভরা স্নিগ্ধ সুন্দর মানুষ দু’জনের আন্তরিক আহ্বানে মুগ্ধ হয়ে ছুটে গেলাম উনাদের পিছু পিছু। নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। একসাথে বসে মায়ের মতো করে নিজ হাতে পরিবেশন করে খাইয়ে সেদিন পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন। সেই দু’জন মানুষ হলেন, পরম শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ও দিপালী চক্রবর্তী।
শ্রাবণের সেই বর্ষণমুখর অন্ধকার রাতে যে আলোকিত মানুষটির সান্নিধ্য লাভ ও শাসন-সোহাগে দেড় যুগেরও অধিক সময় পথচলা, আমার জীবনের পথ প্রদর্শক, আমার অনুপ্রেরণা মাতৃতুল্য পরম শ্রদ্ধেয় মাসিমা দিপালী চক্রবর্তী।
আজ ৩১ মে। ২০০৩ সালের এমনই দিনে আমি হারিয়েছিলাম আমার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন ও সাংগঠনিক জীবনের অভিভাবক দিপালী চক্রবর্তীকে। শারীরিকভাবে তিনি অনুপস্থিত কিন্তু কর্মের মধ্যে সর্বদা উনার উপস্থিতি অনুভব করি। কারণ আমি দেখেছি উনাকে রান্নাঘর থেকে রাজপথে। সর্বত্রই দেখেছি বলিষ্ঠ বিচরণ। সব ঝড়, ঝঞ্ঝা, বাধা অতিক্রম করার বিশাল প্রাণশক্তির অধিকারী একজন মহিয়সী নারীকে। আমার কাছে তিনি প্রাতঃস্মরণীয়া।
বিশাল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মানুষটিকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার নেই। একেবারে কাছ থেকে দেখা মানুষটিকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা থাকলেও কখনো হয়ে উঠেনা আবার সাহসও পাইনা। কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় গিয়ে শেষ করবো! সমাজের সকল প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পুরুষশাসিত অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে দিপালী চক্রবর্তী নামে পরিচয়ে বাড়ি ও সন্তান-সন্ততির পরিচিতি ও একজন দিপালী চক্রবর্তী হয়ে ওঠার বিষয়টি আজকের প্রেক্ষাপটে গবেষণার বিষয়বস্তু বটে।
এই প্রান্তিক জেলায় পরিবার ও সমাজের রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, সকল প্রকার বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটাতে হাতে গোনা যে কয়জন নারী বের হয়ে এসেছিলেন তাঁদেরই একজন দিপালী চক্রবর্তী। শহরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় সংগঠনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন দিপালী চক্রবর্তী। প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল দিপালী চক্রবর্তীর বাড়ি এবং সকল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণশক্তি ছিলেন দিপালী চক্রবর্তী।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার সাথে মাসিমার সাংগঠনিক পথচলা। আহ্বায়ক কমিটি যখন গঠন হয় মাসিমা তখন ঢাকায় ছিলেন। এসে শুনে খুব খুশি হলেন। তখন আমি আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য। উনার পদ-পদবীর কোনো লোভ ছিল না। ওই আহ্বায়ক কমিটিতে তিনি ছিলেন না। তিনিই এগিয়ে এলেন। আহ্বায়ক কমিটির সভায় নেতৃত্ব দিকনির্দেশনা দিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করে সবাইকে নিয়ে মাঠে নেমে অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে সকল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে ২য় সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন। সবাইকে নিয়ে কাজ করাই ছিলো উনার সাংগঠনিক কৌশল। শুরু হলো শূন্য হাতে পথচলা। অফিস নেই, খাতাপত্র নেই। এই শূন্যতা একদিন আমাদের পূরণ করতে হবে এই আত্মপ্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। একেকদিন একেক বাসায় সভা, এই ভাবেই চলছিল। তিনি টের পেলেন, সংগঠন আশানুরূপ গতিশীল হচ্ছেনা। সবাইকে জানিয়ে দিলেন, যতদিন পর্যন্ত নিজস্ব অফিস না হবে ততদিন আমার ড্রয়িংরুম অফিস হিসাবে ব্যবহার করবো। শুরু হলো সুসংগঠিতভাবে পথচলা। শুধুই কি ঘর ব্যবহার? জেলা নেতৃবৃন্দের আপ্যায়ন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের থাকা খাওয়া, সর্বোপরি ভিকটিমের আশ্রয় সব কর্মকাণ্ডই শুরু হয়েছিলো এই বাড়িকে কেন্দ্র করে মাসিমার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং উদারতায়।
৪ঠা এপ্রিল ২০০০। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমরা খুব উৎসাহ আনন্দ নিয়ে পুরাতন পৌরসভা চত্বরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর দুইটায় একজন এসে জানালো সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বনানীপাড়া এলাকায় এক গৃহবধূকে নির্যাতন করে ঘরে আটকে রেখেছে। সাড়ে তিনটায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি। মাসিমা সভাপতি। মাসিমার সঙ্গে আলোচনা করে বললাম, “কর্মসূচি শেষ করে আমরা সবাই মিলে গিয়ে ওই গৃহবধূকে উদ্ধার করবো।” কিন্তু বাঁধ সাধলেন মাসিমা। তিনি বললেন, “তোমরা অনুষ্ঠানে যাও। আমি মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।” যিনি খবর নিয়ে এসেছিলেন, উনার সঙ্গেই তিনি চলে গেলেন, কাউকে ছাড়াই। সেদিন ছিল একাদশী। মাসিমা একাদশীর উপবাস ছিলেন। ডায়াবেটিস রোগ ছিল উনার নিত্যসঙ্গী। তখন তো এখনকার মতো মুঠোফোন ছিলো না। মাসিমা কোথায় গেলেন? কার সাথে, কার বাড়িতে গেলেন? আমরা কোনো কিছুই চিনিনা, জানিনা। আমরা পুরাতন পৌরসভা চত্বরে জমায়েত নিয়ে অপেক্ষা করছি। সভাপতি এলেই তো সভা শুরু হবে। বিকাল চারটার উপরে বাজে। কেউ ছটফট করছেন, কেউ বিরক্তিও প্রকাশ করছেন। সংগঠনের আদর্শিক কাজ কি, অনেকেই জানেন না। অপেক্ষার শেষ করে অবশেষে তিনি এলেন বিপ্লবীর বেশে। নির্যাতিত গৃহবধূকে উদ্ধার করে সাথে নিয়ে এসেছেন বাড়িতে।
এভাবেই প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই ছিল সাহসী নেতৃত্ব। এইরকম সাহসী ভূমিকা ও কাহিনী সৃষ্টি করে রেখে গেছেন আমাদের জন্য। অনুভব করি সারাক্ষণ। ধারণ করি শক্তি। গতিশীল করি নারী আন্দোলন। কারণ আমার সকল কর্মকাণ্ডে যাঁর প্রভাব তিনি হলেন বাংলাদেশের নারী আন্দোলন তথা সুনামগঞ্জের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ পরম শ্রদ্ধেয় মাতৃসম মাসিমা দিপালী চক্রবর্তী। প্রয়াণ দিবসে জানাই সহস্র প্রণাম।
[লেখক গৌরী ভট্টাচার্য্য : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ জেলা শাখা]

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com