নাসরীন আক্তার খানম ::
কয়েকদিন আগে এক পরিসংখ্যান থেকে জানলাম দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কেন এই হার এতো বেড়ে গেল সে কারণ খোঁজার দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের অথবা যারা সমাজ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করেন ও বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেন তাঁদের। সমাজের একজন অংশীদার হিসেবে, একজন নারী হিসেবে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা আছে সেগুলো আমার বলার প্রচ- ইচ্ছে থেকেই এই লেখা।
বর্তমান বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এবং তা সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ২০১০ দশকের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ’৭০, ’৮০ কিংবা ’৯০ দশকের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক তফাৎ প্রযুক্তির কল্যাণেই। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, যোগাযোগের উন্নয়ন বিদ্যুতায়ন সবকিছু এই পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও এসেছে ব্যাপক অগ্রগতি। নারীরা উচ্চশিক্ষা লাভ করছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। তো এইযে অগ্রগতি, এই যে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলা সবকিছুর সাথে নিজেকে পরিবর্তন করে মানিয়ে নিয়ে চললেও নারী স¤পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি প্রায় ক্ষেত্রেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়। বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ায় ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেকেই নারীর শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশকে প্রকারান্তরে দায়ী করতে চাইছেন।
নারী শিক্ষা নারীকে দিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি। পাশাপাশি নিরক্ষর নারীরাও পাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে টাকা উপার্জনের সুযোগ। একজন সুশিক্ষিত নারী কর্মক্ষেত্রে সম্মানের সহিত মর্যাদার সহিত নিজেকে অধিষ্ঠিত করার পরও যখন নিজের প্রাপ্য সম্মান পান না তখনই প্রতিবাদ করেন কারণ ন্যায়-অন্যায় বিষয়টি তার কাছে ¯পষ্ট। নারীর প্রতি কৃত বিভিন্ন অপরাধের বিচার করার জন্য ও শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আইনগুলো এখন অনেক মজবুত।
আমি অবাক হই এখনও অনেক পরিবার একজন সদস্যকে বিবাহ করাবার পর তার বউটিকে সমস্ত পরিবারের বউ মনে করে! মনে করে সে তাদের ইচ্ছের ক্রীড়নক। যেমন খুশি ব্যবহার, বউয়ের বাবার বাড়ির মানুষজনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, বউকে দাসীর মত খাটাবার সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এরা হাসিমুখে স¤পন্ন করে। অনেক ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা থাকে শাশুড়ি ও ননদের। তারাও যে নারী তখন এটা ভুলে যায়। কাজেই নারীর প্রতি অত্যাচার ও বঞ্চনার মাত্রা প্রায় সংসারেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
একজন শাশুড়ি ভাবেন ছেলে বিয়ে করিয়ে মেয়েটিকে তিনি ধন্য করেছেন। এযে তার বংশরক্ষার ধারক এটা ভাবেনই না। আর ননদরা ভাবে যা ইচ্ছে বউটির সাথে ব্যবহার করার অধিকার তার আছে। অথচ বউটির উপর আইনত তাদের যে কোন অধিকারই নেই সেটা বেমালুম ভুলে যায়। ক্রমাগত এভাবে চলতে চলতে একসময় শান্ত বউটি হয়ে যায় বিদ্রোহী।
সবচে মজার ব্যাপার হল যেসব শাশুড়ি বউকে অত্যাচারে ‘এক্সপার্ট’ তারাই আবার নিজের মেয়েদের বেলায় অন্যরকম। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পুত্রের সংসারে, ভায়ের সংসারে কূটকৌশলে ব্যস্ত মা-বোনেরা তাদের মেয়ে বা বোনের সংসারে কিভাবে রাজনীতি করতে হয় তা শিখিয়ে দেয়। তাই তাদের মেয়ে-বোনেরা যখন অন্য একটি পরিবারে বউ হয়ে যায় তখন সে কিন্তু অত্যাচারীই হয়। শাশুড়ি ননদকে সে অত্যাচার করে কারণ সে এটা মায়ের কাছে বোনের কাছে শিখে এসেছে। স্বার্থপরতা ও হীনমন্যতাই এদের সম্বল। যে মেয়ে নিজে তার ভাইয়ের বউকে অশান্তি দেয়না, সে তার স্বামীর সংসারেও ননদ বা শাশুড়িকে অশান্তি দিবেনা।
একজন নারীকে বিয়ের কিছু শর্ত আছে। শর্তসমূহ- সাধারণত একটি আইনসম্মত বৈধ বিয়েতে নি¤œলিখিত পাঁচটি শর্ত পালন অপরিহার্য। যথা- ১. বর ও কনের উপযুক্ত বয়স (আইন সম্মতভাবে বরের বয়স ২১ বছর ও কনের বয়স ১৮ বছর), ২. বর ও কনের স্বাধীন সম্মতি, ৩. সাক্ষী, ৪. দেনমোহর, ৫. বিয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি।
দেনমোহর হলো স্ত্রীর প্রতি সম্মানসূচক স্বামীর একটি আবশ্যিক দেনা। মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো কিছু টাকা বা অন্য কোনো স¤পত্তি যা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের মূল্যস্বরূপ পাওয়ার অধিকারী হয়। একজন নারীর অধিকারপ্রাপ্তিতে প্রথমেই দেনমোহরপ্রাপ্তির বিষয়টি চলে আসে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে, সন্তুষ্ট চিত্তে তারা মোহরের কিয়দংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করবে।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-৪)। দেনমোহর ইসলামে এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে স্ত্রীর অধিকার পাকাপোক্ত করা হয়। পরিশোধের ভিত্তিতে দেনমোহর দুই ধরনের হয়। যথা- মুয়াজ্জল (আশু) দেনমোহর এবং মু-অজ্জল (বিলম্বিত) দেনমোহর। আশু দেনমোহর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হয়। আর বিলম্বিত দেনমোহর হচ্ছে, দেনমোহরের যে অংশটুকু স্বামীর মৃত্যুর পর, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের পর স্ত্রী পেয়ে থাকেন। প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, তালাকের কারণে দেনমোহর দিতে হয়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। দেনমোহর বিয়ের শর্ত। তালাকের সঙ্গে এর স¤পর্ক নেই। বিয়ে বিচ্ছেদ হোক বা না হোক দেনমোহর পরিশোধ করা স্বামীর দায়িত্ব।
স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রাপ্য : পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-“তোমরা সামর্থ্যানুযায়ী নিজেরা যেরূপ গৃহে বাস কর, স্ত্রীদের বসবাসের জন্যও তদ্রুপ গৃহের ব্যবস্থা করে দাও। তাদের কষ্ট দিয়ে জীবন সংকটাপন্ন কর না।” [সূরা তালাক, আয়াত- ৬]
এই আয়াত থেকে ¯পষ্ট যে, স্ত্রীর জন্য স্বামীকে পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে বন্দোবস্ত করতে বলা হয়নি।
কুয়েত থেকে প্রকাশিত “আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়া (ফিকহী বিশ্বকোষ)” তে এসেছে- স্ত্রীর সাথে একই ঘরে পিতামাতা (বা অন্য কোন আত্মীয়) কে বসবাস করতে দেয়া জায়েয নয়। তাই স্বামীর কোন আত্মীয়ের সাথে একত্রে বসবাস করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে। আলাদা বাসাতে থাকলে স্ত্রী তার ইজ্জত, স¤পদ, নিজস্বতা ও অন্যান্য অধিকার উপভোগ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা পেতে পারে। সুতরাং এ অধিকার পরিত্যাগে তাকে বাধ্য করার সাধ্য কারো নেই।
হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি মাযহাবসহ অধিকাংশ ফিকাহবিদগণের অভিমত এটি।
স্বামীর পিতামাতা বা আত্মীয় স্বজনদের প্রতি স্ত্রীর করণীয় :
আসলে কোন স্ত্রীই তার স্বামীর পিতামাতা বা স্বজনদের সেবা যতœ করতে বাধ্য নন। বাংলাদেশের ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন,২০১৩’ তেও পিতা-মাতার ভরণপোষণ ও দেখাশোনার আইনি দায়িত্ব সন্তানের উপর অর্পণ করা হয়েছে- পুত্রবধূদের উপরে অর্পণ করা হয়নি। তাই পুত্রবধূ কর্তৃক শ্বশুর-শাশুড়ির ভরণপোষণ ও খেদমত করার আইনি কোন বাধ্যবাধকতা নাই। তবে এই আইনের ধারা- ৫(২) অনুযায়ী কোন স্ত্রী/স্বামী অপরপক্ষের পিতা-মাতার ভরণপোষণে বাধা-প্রদান করলে সেটি দ-নীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
বলা হয়েছে এই আইন অনুযায়ী ভরণপোষণে বাধা প্রদান করলে- কাজেই এখানে স্বামীর ভাই বোন বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন নন। কোন স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বামীর মা-বাবা ও আত্মীয়দের সাথে একত্রবাস ও সেবা-যতœ করে সেটি স্ত্রীর ‘দয়া’ বা ‘ইহসান’ মাত্র- দায়িত্ব নয়, এই কাজে স্ত্রী ‘সওয়াব’ পাবেন, এটি পালন না করলে বা পালনে অস্বীকার করে শ্বশুরবাড়ির লোকদের থেকে আলাদা থাকতে চাইলে তাতে তার গুনাহ হবেনা, অপরাধ বা বেআইনি তো নয়ই।”
কাজেই যুগ যুগ ধরে পরিবারগুলোতে স্ত্রী নামক বস্তুটির উপর যে অত্যাচার/অবিচার চলছে শিক্ষা নামক আলো সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সহায়তা করছে, চোখ খুলে দিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রাপ্ত অনেক নারীর। আজ তাই প্রচলিত ধ্যান ধারণার অধিকারী-অত্যাচারী মানসিকতার সাথে শুরু হয়েছে নারীর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে জিততে গিয়ে কঠোর আঘাত হানছে পরিবার নামক সংগঠনটিতে। কখনও পরিবারগুলো বাবা মা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, নতুবা বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে।
ইসলামে নারীর যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তার প্রতি সচেতন এবং অজ্ঞান অনেকে। আজ নারীর জেগে উঠেছে। নারীকে প্রাপ্য সম্মান দিন, বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম এই কারণ স্ত্রী হিসেবে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা সুনিশ্চিত করুন, বিবাহ বিচ্ছেদ কমে আসবে।