সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
স্টেটস্ম্যান পত্রিকার মনোজিৎ মিত্রের একটি রিপোর্টÑ ত্রিপুরা সীমান্ত শহর সাব্রুম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলছে সংকীর্ণ ফেনী নদী। এপ্রিল মাসের এক সকালে নৌকা করে নদী পার হচ্ছিলাম। আমার পেছনে দেখতে পেলাম হাজারো বাংলাদেশি শরণার্থী। নদী পার হবার অপেক্ষায় আমার সামনেও হাজারো মানুষ। অগণিত মানুষ অগভীর জল মাড়িয়ে জিনিসপত্র কাঁধে করে অপরপাড়ে যাচ্ছেন। ১৫ কিলোমিটার দূরে তুমুল গোলাগুলি এবং তাদের যাত্রা ছিল অব্যাহত। সীমান্তবর্তী রামগড় তখনো মুক্তিফৌজের দখলে। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি সামনে এগিয়ে আসছিল। তারা নির্মমভাবে শেলিং করে গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এই গ্রামগুলি থেকেই হাজারো মানুষ পালিয়ে আসছে।
লাকসাম বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ এবং ‘ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুদ্ধিস্ট’-এর পাকিস্তান শাখার সভাপতি জ্যোতিপাল মহাথেরো ২১ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় আশ্রয় নিয়ে বলেনÑ সপ্তাহ আগে কুমিল্লার লাকসাম থেকে লালমাই পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় ৩০টি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট, নির্যাতন, হত্যাকান্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। লাকসামের বৌদ্ধবিহারটিও আক্রমণ করে ধ্বংস করে। বৌদ্ধ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই অঞ্চলে বহু লোককে হত্যা করা হয়। ভিক্ষু নিজে গ্রামের পথে এলোমেলো মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।
আগরতলার সকল হাসপাতাল শরণার্থীতে ঠাসা। অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। বেয়নেটের আঘাত, অর্ধদগ্ধ শরীর। ধারণ ক্ষমতার তিনগুন রোগী। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার এবং জিবি হাসপাতালে দুই হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। আগরতলার চিকিৎসকরা দিন-রাত ব্যস্ত। দিল্লি থেকেও একদল ডাক্তার এসে পৌঁছেন আগরতলায়। বেশকিছু শরণার্থী ডাক্তার-নার্সরাও রয়েছেন। সাংসদ মমতাজ বেগম, বদরুন্নেসা আহমদ, ডা. নূরজাহান জহুরের প্রচেষ্টায় নার্সিং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলে শরণার্থী শিবির থেকে স্কুল কলেজের অনেক ছাত্রী এবং মহিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে জিবি হাসপাতাল, ভিএম হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবিকা, সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োজিত হয়। ডা. নুরুন্নাহার জহুর চিকিৎসক হিসেবে যোগদেন জিবি হাসপাতালে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশনের ত্রিপুরা শাখা ও রেডক্রস শরণার্থী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় আপদকালীন চিকিৎসাকেন্দ্র খোলে।
হরিয়ানা রাজ্য বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির অর্থায়নে আগরতলায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিকলাঙ্গ আবাসনকেন্দ্র স্থাপিত হয়। এতে আহত শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা দেয়া হত। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ক্যাপ্টেন আক্তার সোনামুড়ায় যে হাসপাতালটি গড়ে তোলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের প্রচেষ্টায় মুজিবনগর সরকার পরবর্তীতে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয় এবং পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রূপ পায়। নিরাপত্তার জন্য পরে এটি স্থানান্তরিত হয় হাবুল ব্যানার্জির বাগানে, বিশ্রামগঞ্জে। ডা. জাফর উল্লাহ ও ডা. মুবিন বিলাত থেকে এসে যোগ দেন এ হাসপাতালে। ২নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন হায়দারের ছোটবোন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন সিতারা এর কমান্ডডেন্ট ছিলেন। অনেক বাংলাদেশি ডাক্তার, মেডিকেলের ছাত্রছাত্রী নার্স এবং অবরুদ্ধ দেশের ভিতর থেকে স্কুল কলেজের অনেক ছাত্রী সেবিকা ও সাহায্যকারী হিসেবে এ হাসপাতালে এসে যোগ দেয়। গীতা মজুমদার, শেফালিকা দাস, কমলা কলকাতার গোবরা ক্যাম্পে ট্রেনিং গ্রহণ করে এখানে এসে যোগ দেন। মেডিকেল ছাত্রী ডালিয়া, নার্স পদ্মা, গৃহিণী খুকু আহমদ, সবিতা, গীতা, কল্পনা, অনুপমা, আসমা, রেশমা, মিনু বিল্লাহ এবং কবি সুফিয়া কামালের দুই কিশোরী কন্যা লুলু, টুলুও এ হাসপাতালে কাজ করেছেন। শিক্ষানবীশ ডাক্তার এবং মেডিকেল ছাত্র একেএম শামসুদ্দিন, মোর্শেদ চৌধুরী, কিরণ দেবনাথ, লুৎফুর রহমান চিকিৎসা সেবায় নিবেদিত ছিলেন। অন্যান্য সেক্টর হেডকোয়ার্টার হাসপাতালের তুলনায় এর কার্যক্রম ছিল ব্যাপক। ছনের ছাউনি, বাঁশের খুঁটি সযতœ পরিচর্যায় লেপা-মোছা ২’শ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালটি বাংলাদেশ হাসপাতাল নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তাঞ্চল থেকে ট্রাকভর্তি করে নিয়ে আসা হয় মেয়েদের। এরা নির্যাতিতা। রাজাকার-আলবদর এদের তুলে দিয়েছিল পাকবাহিনীর কাছে। পাঞ্জাবিরাও কখনো বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যেত যুবতী মেয়ে, গৃহবধূদের। বীভৎস্য অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত বিধ্বস্ত বিবস্ত্র নারীরা। সারদা সেবা সংঘ এদের কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করে। কমরেড ফরহাদ, মমতাজ বেগম, গৌরী ভট্টাচার্য্যরে প্রচেষ্টায় এবং ডা. পুষ্প দে, ডা. শীলা ঘোষ, ডা. সুবোধ বসাকের সহায়তায় এদের চিকিৎসা চলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালে। (চলবে)