বিবেক ব্রহ্মচারী ::
সাধারণভাবে ধর্ম বলতে আমরা বুঝি যা আমাদের ধারণ করে তাই ধর্ম। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুরই একটি বিশেষত বা মৌলিকত্ব আছে যাকে আমরা তার ধর্ম বলি। যদি বলি- দুধ কেমন- ধবল, তেল কেমন- তরল, আগুন কেমন- দাহক অর্থাৎ যা দহন করে বা পোড়ায়। কিন্তু দুধ যখন তার ধবলত্ব হারায়, তেল যখন তরলত্ব হারায়, অগ্নির যখন দহন শক্তি থাকেনা- তখন তাকে আর দুধ, তেল বা আগুন বলা যাবেনা। ঠিক তেমনি যে কোন বস্তু, প্রাণী বা মানুষ তার চৈতন্য সত্ত্বার সাথে সংযোগ হারালেই ওই বন্তুটির ধর্ম তার পূর্ণতা হারায়। তাই ঈশ্বর সৃষ্ট জগতের সেরা জীব মানুষ, আর মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব। কিন্তু তখনই আমরা তার পূর্ণতা পাই মানব যখন মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে, দেবত্ব থেকে শিবত্ব প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে বিজ্ঞান বলছে, এই বিশ্ব ব্রহ্মা-ের ব্যক্ত (ঠরংরনষব) সকল কিছ্ইু এক মহাশক্তি (ওহারংরনষব ভড়ৎপব) দ্বারা একটি সীমাবদ্ধ বলয়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম (ঈযধরহ ড়ভ ঝুংঃবস) মেনে চলছে। এর এক বিন্দু পরিবর্তন মহাজাগতিক ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাহলে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বিশাল বিশাল গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র সূর্য্য ও একটি নিয়মের দ্বারা পরিচালিত।
স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বের সকল মানব জাতিকে আমরা দুটি প্রকৃতিতে ভাগ করতে পারি (১) অসুর প্রকৃতি (মন্দ) (২) দৈবী প্রকৃতি (ভাল)- কিন্তু অধ্যাত্বশাস্ত্র বলছে মানুষ স্বরূপত মন্দ বা ভাল কোনটিই নয়। কারণ আত্মা জড়াব্যাধি জন্ম মৃত্যুর ও অধীন নয়। কিন্তু আত্মা যখন স্বশরীর ধারণ করছে তার চিন্তা, কর্ম, তার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ তার প্রকৃতি (ঐঁসধহ ঘধঃঁৎব) তৈরী করছে। যখনই আমরা শুদ্ধ বুদ্ধ চৈতন্য জ্ঞানের দিকে নিজের জীবনকে চালিত করে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হই তখনই আমাদের দৈবী প্রকৃতির (অনংড়ষঁঃব ঘধঃঁৎব) প্রকাশ পায়, আর তার বিপরীত হলেই (ঊারষ ঘধঃঁৎব) ক্রিয়াশীল হয়। সুতরাং পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলাই ধর্ম।
এবার আমরা আরো একটু গভীরে প্রবেশ করব। শ্রী শ্রী চন্ডীর একটি শ্লোক এখানে আলোচ্য-
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥-শ্রীশ্রী চন্ডী ৫-৭১/৭২/৭৩
অর্থাৎ, যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা তাঁকে পুন: পুন: নমস্কার।
পৃথিবীতে ‘মা’ না থাকলে কি ঘটতো আমরা কি বলতে পারি। জীব বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ণ’ ক্রমোজম না থাকতো তাহলে এই তাবৎ জগতের সৃষ্টিতত্ত্ব কিভাবে সাধিত হতো। একটি শিশু ছোট থাকা অবস্থায় মা, বাবার পার্থক্য ঠিক ঠিক বুঝতে পারে। মায়ের শরীরের গন্ধ, মাতৃস্তন্য তাকে মাতৃ সান্নিধ্য সম্পর্কে ভিন্ন অনুভূতি প্রদান করে। ওই সময়টাতে তার অস্তিত্বে একমাত্র মাতৃসংস্পর্শই ক্রিয়াশীল থাকে। শিশুকালের এই সময়টাকেই আমাদের দৈবী প্রকৃতির (অনংড়ষঁঃব ঘধঃঁৎব) সাথে তুলনা করতে পারি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন এই শিশুটিই তার মাতৃআলিগংনের গ-ী থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভোগ ও মোহাচ্ছন্ন জগৎ যখন তার সঙ্গী হয়। চারিত্রিক দৈন্যতা ও সামাজিক সঙ্গ তাকে আসুরিক (ঊারষ ঘধঃঁৎব) প্রবৃত্তির দিকে ধাবিত করে। তখন সেই মাতৃজাতীকেই দৃষ্টি, বাক্য, মন, শরীর দ্বারা প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে প্রতিনিয়িত ধর্ষন করি। তখন একবারও ভাবি না-
“যাতে জন্মিলি, তাতেই মইলি।”
চন্ডীতে সেই মাতৃশক্তিকে স্তুতি করা হচ্ছে-
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরুপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ শ্রীশ্রী চন্ডী ৫-৩২/৩৩/৩৪
অর্থাৎ, যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অবস্থিতা তাঁকে পুন: পুন: নমস্কার।
স্বামীজী বলেছেন- ‘আমাদের দেশ হীন কেন? মাতৃ শক্তির অবমাননা হয় বলে। মাতৃভক্ত জগৎ জয় করে।’ তিনি আরো বলেছেন নারীদের পূজা করেই সব জাতি বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতিতে নারীদের পূজা হয় না। সে দেশ, সে জাতি কখনও বড় হতে পারে না। কষ্মিনকালেও পারবেনা ।
মনু বলছেন-
যত্র নার্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তেু তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতান্তু পূজ্যন্তে সর্বান্তুত্রাফলাঃ ক্রিয়া ॥
অর্থাৎ, সেখানে নারীগণ পূজিতা হন, সেখানে দেবতারাও প্রসন্ন হন। যেখানে নারীগণ সম্মানিতা হন না, সেখানে সকল কাজেই নিষ্ফল। যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে। সে সংসারের, সে দেশের কখনও উন্নতির আশা নেই। তাই এখানে স্পষ্টতই বলা যায়, কুমারী প্রতীকে আমাদের মাতৃরূপে অবস্থিতা সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা। যিনি এই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালনের সূক্ষশক্তি রূপে অবস্থিতা।
বিজ্ঞানী সক্রেটিস বলতেন- ‘যে ব্যক্তি জীবনে শক্তির স্বাদ পায়নি তার জীবন বৃথা।’ গীতায় ভগবান অবতার রূপ ধারণ প্রসঙ্গে বলছেন- ‘প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যত্মমায়য়া’- অর্থাৎ এই ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকে আশ্রয় করে স্বমায়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। এখানে ‘স্বমায়া’-ই হচ্ছে শ্রীভগবানের মৌলিক শক্তি, একে আমরা বৈষ্ণবী শক্তি বা ব্রহ্মশক্তি বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এ শক্তিকেই সনাতন ধর্ম- মহামায়া, যোগমায়া, কালী, দুর্গা নামে বর্ণনা করছে। এই শক্তির সহায়তায়ই পরমপুরুষ এই জগৎ সৃষ্টি ও পরিচালনা করেন। আমরা নিজেরাও এশক্তির দ্বারাই পরিচালিত হই। কেননা কেউ যদি বলে ‘শক্তি মানিনা’- এ কথাটি বলতেও তার বাকশক্তির প্রয়োজন। কেউ যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলেও কেউ বলতে পারবেনা যে সে শক্তি গ্রহণ করছেনা, কারণ ঘুমন্ত অবস্থায়ও হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান থাকে। এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও মনের সূক্ষ তরঙ্গ সজাগ (অপঃরাব) থাকায় ঘুম থেকে উঠে ব্যক্তি বলতে পারে গত রাতে সে কি স্বপ্ন দেখেছিল। তাই শক্তি প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন- ‘শক্তি সিন্ধু মাঝে রহি হায় শক্তি পেলনা যে, মরিবার বহু পূর্বে, জানিও মরিয়া গিয়াছে সে।’
দেবী ভাগবতে আছে- ‘সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিনী। রূপং বিভর্ত্য রূপা চ ভক্তানুগ্রহহেতবে।’ অর্থাৎ সেই সচ্চিদানন্দের পরাশক্তি নির্গুণা হয়েও আধারে বিভিন্ন প্রতিমায় গুণ ধারণ করেন। অরূপ হয়েও কৃপা করার জন্য সাধকগণের কাঙ্খিত রূপ ধারণ করেন। তাই উনবিংশ শতাব্দিতে মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাবটিকে অনুভব করে বললেন- “তোমরা যাকে ব্রহ্মা বল আমি তাকে কালী বলি।” আবার যিনি কালী তিনিই দুর্গা।
যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ শ্রীশ্রী চন্ডী ৫-১৭/১৮/১৯
অর্থাৎ, যে দেবী সর্বপ্রাণীতে চেতনারূপে অবস্থিতা তাঁকে পুন: পুন: নমস্কার।
তাই, শ্রীরামকৃষ্ণের উপলব্ধি-প্রকৃতপক্ষে মৃন্ময়ী প্রতিমার রূপে চিন্ময়ীর আরাধনা, আবার মৃন্ময়ী থেকে জীবন্ত কুমারীর পূজা-আধার যে রূপই হোক এখানে সাধকের প্রকৃত প্রার্থনা হচ্ছে, হে দেবতাঃ, তুমি আমার পরমাত্মারূপে এই হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত আছ। তুমি এই আধারে আবির্ভুত হও (তা সে মৃন্ময়ী প্রতিমা হোক আর জীবন্ত কুমারী হোক)। এখানে দুর্গাকে যেমন পরাশক্তি সচ্চিদানন্দরূপিনী বলা হচ্ছে তেমনি জড় জাগতিক পৃথিবীতে নারী জাতিই হচ্ছে সেই পরাশক্তির প্রতিরূপ- আর এজন্যই জীবন্ত কুমারীর পূজা সেই মহাশক্তিরই পূজা ।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই প্রসঙ্গে আরো বলছেন- “কুমারী পূজা করে কেন? উত্তর- ঠাকুর বলছেন সব স্ত্রীলোকই ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। এই মাতৃশক্তি ভগবতীই আমাদের মধ্যে মহৎ গুণাবলী রূপে বিরাজমান। কুমারী পূজা সেই জগৎমাতারই কল্পিত রূপ। তাই কুমারী পূজার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তাকেই শ্রদ্ধা জানায়, যিনি সকল প্রাণীতে মাতৃরূপে, শক্তি রূপে এবং চেতনা রূপে অবস্থিতা।
সুতরাং নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে মাতৃশক্তিরূপে নারীকে সম্মান জানানোই কুমারী পূজার মূল লক্ষ। আর এভাবেই জগন্মাতার আরাধনা করে আমরা আমাদের দৈবী চরিত্রের (অনংড়ষঁঃব ঘধঃঁৎব) দ্বারা বিশ্ব সভ্যতার প্রভূত কল্যান সাধন করতে পারি।
সহায়ক গ্রন্থঃ-
১। শ্রী শ্রী চ-ী- স্বামী জগদ্বীশ্বরানন্দ- উদ্বোধন কার্যালয়
২। মহাশক্তির বিচিত্র প্রকাশ- স্বামী অক্ষরানন্দ, ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ।
৩। শক্তি- অমৃতানন্দ