বিভুরঞ্জন সরকার::
এ বছর দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পটভূমিতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর চালিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হতে পারেনি। সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় সারা দেশেই শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর পরিবেশে দুর্গোৎসব উদ্যাপিত হয়েছে। দুর্গাপূজা উদ্যাপন নিয়ে নানা কথা-কাহিনি আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কাহিনিটি এমন: কোনো এক সময় ‘দুর্গম’ নামক এক অসুর ছিল। সৃষ্টিকুলকে দুর্গতিতে ফেলাই ছিল তার প্রধান কাজ। সেই দুর্গম অসুরকে বধ করেছিলেন যে দেবী, তাঁরই নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতাদের হৃত রাজ্যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং জীবজগৎকে চিরকাল দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। ভারতবর্ষের বাঙালি হিন্দু মানসে দুর্গা প্রতিবাদের দেবী, প্রতিরোধের দেবী। একই সঙ্গে দেবী দুর্গা মাতৃরূপে ও শক্তিরূপেও বাঙালি হিন্দু সমাজে পূজিত হন। তিনি একদিকে সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধার হিসেবেই বিবেচিত হন, অন্যদিকে তিনি অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয় বলেও গণ্য হন। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেক রূপ মাতৃময়ী ভালোবাসার। শক্তি ও মমতার এ দুই শক্তির গুণেই তিনি দেবকুলের কাছে পরম পূজনীয় হিসেবে গণ্য হন। মানবকুলের জন্য তিনি বহন করে আনেন মঙ্গলবার্তা। যেকোনো ধর্মের পরম প্রতীকের গুরুত্ব এখানেই যে, তা সব মানুষের মধ্যেই শুভবোধের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম। বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। এক ধর্মাবলম্বী অন্য সম্প্রদায়ের বিপদে-আপদেও পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে এর ব্যতিক্রম যে দেখা যায় না, তা নয়। ধর্মকে সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর একটি অশুভ শক্তি সম্প্রীতির ঐতিহ্যে কালি ছিটিয়ে দেয়। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিভাজন আমাদের সামনে একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। দুই. মানুষকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে বিভাজন করাটা সমীচীন না হলেও এটা বিশ্বব্যাপীই হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুরা সব দেশে, সব সমাজেই কিছুটা আলাদা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সব ক্ষেত্রে একরকম নয়। মূলত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আরও নানাভাবেই এই ভাগ-বিভক্তি করা যায়, করা হয়। ধর্ম ছাড়াও মানুষের বর্ণ (গায়ের রং), বিশ্বাস, চিন্তা ইত্যাদি দিয়েও সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নিরূপিত হয়ে থাকে। মোটা দাগে পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। আস্তিক-নাস্তিক লড়াই নতুন নয়। কোথাও সাদা রঙের মানুষ সংখ্যাগুরু, কোথাও কালো রঙের। কোথাও মুসলমান সংখ্যাগুরু, কোথাও হিন্দু, কোথাও খ্রিস্টান, কোথাও বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসী। এক ধর্মের মানুষের মধ্যেও সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু আছে, থাকতে পারে। যেমন কোথাও শিয়া মুসলমান সংখ্যালঘু, কোথাও সুন্নি। খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক, প্রটেস্টান আছে। হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন তো মারাত্মক। বিশ্বাস ও চিন্তার ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু আছে। তবে আমরা বাংলাদেশে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতেই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নির্ধারণ করে থাকি। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু আর সনাতন ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দুই খ- হয়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল, তখন স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আর পাকিস্তানি মন্দ উত্তরাধিকার কিংবা ধারা বহন করবে না। পাকিস্তান ছিল ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রটি হবে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চরিত্রের। ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আচরণ ও পালনের বিষয়। রাষ্ট্র হবে সবার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান - সব মানুষের। এমনকি ‘গরিবের নিঃস্বের ফকিরের’ও। রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। বিত্তবান ও বিত্তহীনদের যে বৈষম্য, অর্থাৎ ধনবৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে। কিন্তু বাস্তবে সে রকম হলো না। দেশ স্বাধীনতা হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের মনোভূমির রং বদলাতে লাগল। আজ তা উজ্জ্বলতা হারিয়ে প্রায় ফ্যাকাশে। তিন. অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রত্যয় থেকে আমরা কীভাবে সরে এলাম, নিজেদের মানুষ হিসেবে না ভেবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচিত করার প্রবণতা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসল, সে বিষয়গুলো আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা দাবি করে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনেরা, অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দেশটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে কি না, তা বিতর্কের ঊর্ধ্ব নয়। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশে তা দীর্ঘদিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। একসময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু দেশটি রাজনৈতিকভাবে চরম বিভক্ত হওয়ার পর তা প্রকট ও প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্মবিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল, তার কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তানের পরাজয় মানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয়। যে মানুষ ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তানের ভৌগোলিক কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিল, রাতারাতি তার মধ্যে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটার কোনো স্বাভাবিক কারণ ছিল না। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে, ক্রমাগত উন্নত বা অগ্রগামী দর্শনচর্চার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কোনো সময় একটি দৃঢ় আদর্শভিত্তিক একশিলা দল ছিল না। এটা ছিল মূলত বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একটি বৃহত্তর জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। এই দলের পতাকাতলে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তারা সবাই এক মত ও এক পথের ছিলেন না। এমনকি দলের নেতৃত্বের মধ্যেও চিন্তার পার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে একাধিক ধারা সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ধারাটি একসময় প্রধান হয়ে উঠলেও তার বিরোধী একটি ধারা দুর্বল হলেও সক্রিয় ছিল। চার. বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র যে আজ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতে পারছে না, সম্প্রীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা যে আজ এক চরম অন্তর্জ্বালা নিয়ে বসবাস করছে, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে অতীতের দিকে চোখ দিয়েই। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে বিলাপসংগীত গেয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়া যাবে না। সেটা গড়তে হলে ঐতিহাসিকভাবে যে ভুলভ্রান্তি আমরা করে এসেছি, তা স্বীকার করে, ফাঁকফোকর মেরামত করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এক ধর্মের মানুষ যদি অন্য ধর্মের মানুষ সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল থাকে, তাহলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কম হতে পারে। সব থেকে বড় কথা হলো, যে যে ধর্মবিশ্বাসী, তাকে সেই ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে। মুসলমান নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি করার অধিকার পাবে, হিন্দুও তার পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে অনায়াসে, অবাধে। অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এমন অবস্থা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষের বিশ্বাস নিয়ে কৌতুক-তামাশা করে কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উপহাস করে, তখনই বিষয়টি আর সহনীয় থাকে না। গোলমাল বাধে, বেধে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাও। অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার অভাব মানুষ হিসেবেই কি আমাদের ছোট করে দেয় না? মুক্ত মনে ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু মানুষের মনোজগতে সংস্কারের বিষয়টি উপেক্ষিত হলে কি নতুন বাংলাদেশ তৈরি সফল হবে? [সংকলিত]
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
মনোজগতে সংস্কার কীভাবে হবে
- আপলোড সময় : ১৪-১০-২০২৪ ১২:৪১:২৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-১০-২০২৪ ১২:৪৪:২০ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ