বিলুপ্তির পথে হাওরাঞ্চলের চিরচেনা হিজলগাছ
- আপলোড সময় : ০২-১০-২০২৪ ০৭:৪৩:০৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-১০-২০২৪ ০৭:৪৩:০৯ পূর্বাহ্ন
দুলাল মিয়া:
হিজলগাছ। হাওরাঞ্চলের চিরচেনা বৃক্ষ। এটি প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার। হাওরের উত্তাল জলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে প্রবল প্রাণশক্তির হিজলগাছ। কখনো একা, কখনো সারিবদ্ধভাবে। পানিতে দাঁড়িয়ে বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্যকে অনন্য করে তোলে হিজলগাছ। হাওরে হিজলগাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। এই গাছ নানাভাবে হাওরের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি ও উপকার করে। হিজলগাছ বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও টিকে থাকে, মরে না। এই গাছ জলা জায়গার আশে পাশে বেশি দেখা যায়। প্রচ- গ্রীষ্মেও গাছটি বেঁচে থাকতে পারে। হাওরাঞ্চলে এ গাছের ডাল মাছের অভয়রাণ্য তৈরিতে অত্যন্ত উপযোগী। অযতœ-অবহেলা ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা হিজলগাছ।
হাওরের জাঙ্গাল, বাড়ির কিনার, কান্দা, খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বাঁওর ও ডোবার ধারে হিজলগাছ জন্মে। হিজলের কাঠ নরম, সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল, মসৃণ ও টেকসই। পানিতে নষ্ট হয় না বলে নৌযান তৈরিতে এর কাঠ ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবেও এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। হালকা গোলাপি রঙে হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। গভীর রাতে ফুল ফোটে। সকালে ঝরে যায়। ফুলে এক ধরনের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ আছে।
হিজলগাছ পশু-পাখি ও মাছের আশ্রয়স্থল। বর্ষায় হাওরে ঝড়ের কবলে পড়লে নৌকারোহীরা আশ্রয় নেয় হিজলগাছে। অন্যদিকে মাটির ক্ষয়রোধ এবং বাঁধ রক্ষার কাজেও এর ভূমিকা অনেক। অথচ দিন দিন হারিয়ে গেলেও হিজল গাছ সংরক্ষণে উদ্যোগ নেই স্থানীয় প্রশাসনের।
হিজলগাছ জেলে ও কৃষকের বন্ধু। প্রখর রোদে কৃষক এর ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারেন। আফাল - তুফান ও ঢেউয়ে ঘরবাড়ি ভাঙ্গনেরর হাত থেকে এটি প্রতিরক্ষার কাজও করে। হাওরাঞ্চলের বিল, নদী-নালা ও জলাশয়গুলোতে হিজলের ডাল কাঁটা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাছের অভয়াশ্রম তৈরিতে হিজলের ডালপালার ব্যবহার বহুল প্রচলিত। অভয়াশ্রম তৈরিতে এর জুড়ি মেলা ভার।
হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার। ইধৎৎরহমঃড়হরধ ধপঁঃধহমঁষধ এর বৈজ্ঞানিক নাম। এটি মাঝারি আকারের ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘজীবী গাছ। সংস্কৃত নাম নিচুল।
হিজল ফুল শেষ হলে গাছে ফল আসে। ফল তিতা ও বিষাক্ত। দেখতে অনেকটা হরীতকীর মতো। হিজলের বিষাক্ত অংশ হলো ফল। হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। গাছটির দুটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। ফুল হয় সাদা ও লাল। পুষ্প মঞ্জুরী কা- থেকে ঝুড়ির মতো ঝোলে। গাছের বিষাক্ত অংশ হলো কাঁচা ফল। হিজলের শুকনো ফলের বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে খেলে পেটের অনেক সমস্যা দূর হয়। এছাড়াও গাছটির অনেক ঔষধিগুণ রয়েছে।
নিজ সৌন্দর্যের গুণে বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই পেয়েছে হিজলগাছ। হিজলগাছের রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে অনেক কবিই কবিতা রচনা করেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপের সঙ্গে হিজল গাছের ছায়াকে তুলনা করে লিখেছিলেন, “এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ।” কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- “হিজল বিছানো বন পথ দিয়া/রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।” বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন- “হাওরের পানি নাই রে হেথায়, নাই রে তাজা মাছ/বিলের বুকে ডালা মেলা, নাই রে হিজলগাছ।”
পরিবেশকর্মী সাইফুল আলম সদরুল বলেন, ঠেলাঠেলির ঘর খোদায় রক্ষা কর। এ দেয় হের ঠেলা, হে দেয় এর ঠেলা। কেউই আসল কাজে নেই। আগে হাওরের জাঙ্গাল, বাড়ির হালট, রাস্তার কিনার, কান্দা, খাল, বিল, নালা, হাওর, ডোবার ধারে ও নদীর তীরে সারি সারি হিজল গাছ ছিল। গেল কয়েক বছর ধরে কারণে-অকারণে এসব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বিলে মাছ সংরক্ষণের জন্য বিলে মাছ সংরক্ষণের জন্য এই গাছ খুবই মূল্যবান। হাওরের বাঁধের কাজের মাটি নেওয়া হয় কান্দা কেটে। এখন কান্দাই নাই, গাছ থাকবে কি করে? হাওর অঞ্চলের বন বাদাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনেই গাজগুলো রক্ষা করতে হবে। হাওরের পরিবেশের দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। হাওরে গাছ-মাছ না থাকলে আমরা হাওরবাসী বাঁচতে পারবো না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রশাসনকেও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায় বলেন, হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের পথে। হাওর এলাকায় আগের মতো আর হিজল-করচের গাছ দেখা যায় না। এসব গাছ পাখি, বন্যপ্রাণী ও মাছের অভয়াশ্রম ছিল। হাওরগুলোতে আগের মতো মাছ নেই, পাখি নেই। পরিযায়ী পাখির আনাগোনাও আগের মতো নেই। একেবারেই কমে গেছে। হাওরগুলো অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। হাওর এলাকায় বনায়নের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাওর অঞ্চলের জন্য বিশেষ বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করলে প্রকৃতি হয়তো তার পূর্বের রূপ ফিরে পাবে। হাওরাঞ্চল ফিরে পাবে তার আসল চেহারা। ফলে বর্ষাকালে হাওর আর অরক্ষিত থাকবে না। আবার হাওরে বড় বড় মাছ হবে, পাখি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবও রোধ করা যাবে। তাছাড়া হাওরগুলোতে মিঠাপানির মাছের নিরাপদ বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র তৈরি হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ