মগজের সংস্কার হবে কীভাবে! অরুণ কর্মকার
মগজ বড় বিচিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ এক বস্তু। মানুষের এবং সমগ্র প্রাণিকুলের তো বটেই, এমনকি যন্ত্রেরও। ক¤িপউটারের হার্ড ডিস্কের মতো। একটু গড়বড় হলেই আর কোনো প্রোগ্রাম ঠিকঠাক চলবে না। সব উল্টাপাল্টা এলোমেলো হয়ে যাবে। ক¤িপউটারের হার্ড ডিস্ক এবং প্রাণিকুলের মগজের মধ্যে এই তুলনাটি অবশ্য উদাহরণ হিসেবে অতি সাধারণ। কারণ, এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। হার্ড ডিস্কে গোলমাল হলে তা মেরামত করা খুব কঠিন নয়। দরকার হলে বদলেও ফেলা যায়। কিন্তু মগজ বদলে ফেলার উপায় নেই। এমনকি মেরামত করাও দুরূহ। বিশেষ করে ধোলাই হওয়া মগজ।
কয়েক যুগ ধরে আমাদের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র যেসব কা-কারখানা দেখে আসছি এবং এখনো দেখতে পাচ্ছি, দেখে যাচ্ছি তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নিশ্চয়ই আমাদের মগজে কোনো গোলমাল হয়েছে। ক্রমাগতভাবে ধোলাই হতে হতে একেবারে আমূল বদলে গেছে আমাদের মগজগুলো। না হলে একজন প্রয়াত মানুষের কবর ভাঙচুর করা, সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া কে কবে দেখেছে এই দেশে? কিংবা পৃথিবীর কোথাও? কার কবর সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, সেটা কবরস্থান এবং আমরা সেটাকে পবিত্র বলে মানি। মগজে ব্যাপক গোলমাল না হলে কী করে কেউ এই কাজ করতে পারে?
উদাহরণ আরও আছে। ভয়াবহ উদাহরণ। তোফাজ্জল নামে এক তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেলার আগে তাঁকে ভাত খাইয়ে নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের একদল শিক্ষার্থী। তরুণটি কোনো এক কালে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কোনো এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তবে সে কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়নি। বছর চারেক ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ঢাকা শহরের ভবঘুরে জীবন ছিল তাঁর। মাঝেমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে গেলে এলাকার পূর্বপরিচিতরা তাঁকে খাবার ও কিছু টাকাপয়সা দিতেন। সম্প্রতি তরুণটি ফজলুল হক হলে গেলে তাঁকে চোর সন্দেহে আটক করা হয়। তারপর তাঁকে ভাত খাওয়ানোর পর পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যে ‘বীর পুরুষেরা’ তাঁকে মেরে ফেললেন, তাদের মগজ সংস্কারের যোগ্য আছে বলে মনে হয় না। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে অভিযোগ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা কিছুটা হলেও আশাজাগানিয়া।
এছাড়া একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়ছে শামীম নামে এক তরুণকে। তিনি নাকি ছাত্রলীগ করতেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁর কাতরানোর শব্দ রেকর্ড করে সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কাউকে এভাবে মেরে ফেলা যায়? যেতে পারে যদি যারা করছেন তাদের মগজ সংস্কারের অযোগ্য হয়ে যায়। এ ঘটনার ভিন্ন একটি ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা সত্য হলে মোটেই কম ভয়াবহ নয়। এই ভাষ্য অনুযায়ী, শামীমকে বেদম প্রহার করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নাকি তাঁকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর প্রক্টর মহোদয় পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এলে শামীম নিজে হেঁটেই পুলিশের গাড়িতে ওঠেন। এর এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে হাসপাতাল থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর আসে। এরপর শামীমের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি মিছিল এবং মানববন্ধনও করা হয়েছে। তাহলে তাঁকে কে হত্যা করল, কীভাবে করল?
এর কয়েক দিন আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে একজন নারীকে (মতান্তরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ) লাঞ্ছিত করায় বিশেষ ভূমিকা রেখে যে তরুণ বীর পুঙ্গব তুমুল আলোচিত এবং শেষমেশ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন, তার মগজের অন্ধকার কি কোনো কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের চেয়ে কম? একই মানের মগজ তো এখন আকছার দৃশ্যমান। সামাজিক মাধ্যমে যেমন তাদের পদচারণ দোর্দ- প্রতাপশালী, তেমনি রাজপথে-প্রান্তরেও তা মোটেই বিরল নয়। কিংবা যে জনতা নীরবে দাঁড়িয়ে ওই নারীর লাঞ্ছনা দেখেছে, তাদের মগজেরও কি সংস্কার দরকার নেই? অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন প্রতিকারহীন ‘মব কিলিং’-এর জয়জয়কার, রাষ্ট্র কিংবা সরকার নির্বিকার, তখন সাধারণ জনতার পক্ষে দর্শক হওয়াই নিরাপদ বটে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিজয়ের পর জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়া, সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে পদ দখলের গাজোয়ারি তৎপরতা, আবাসিক হোটেলে হানা দিয়ে খদ্দেরসহ নারীদের হেনস্তা করার মতো বহু ঘটনা ঘটে গেছে। যা এখনো ঘটে চলেছে তা হলো ‘মব কিলিং’ এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন। এর মধ্যে ‘মব কিলিং’ সম্পর্কে গণমাধ্যমে খবরাখবর পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যটি কমই পাওয়া যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে দশম শ্রেণীতে পড়–য়া একটি হিন্দু মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, অপহরণটি করা হয়েছে পূর্বঘোষণা দিয়ে। ২ সেপ্টেম্বর সেই হিন্দু পাড়ায় গাছে গাছে পোস্টার সাঁটিয়ে জানান দেওয়া হয়েছিল এই অপহরণ করার কথা। পোস্টারে এও বলা হয়েছিল যে মেয়েটিকে মুসলমান (ধর্মান্তরিত) করা হবে। মেয়েটির বাবা ঘটনা সম্পর্কে থানায় জিডি করেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। সংখ্যালঘুদের প্রতি এই আচরণও একপ্রকার বিকারগ্রস্ত মগজের প্রকাশ। এই দেশে এ রকম মগজধারীর সংখ্যা এখন নেহাত কম নয় এবং ক্রমবর্ধমান। এই সব মগজের সংস্কার কে, কীভাবে করবে? না করা গেলে কি দেশ সুস্থ ধারায় ফিরবে?
আসলে এক অদ্ভুত সময় অতিবাহিত করছি আমরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমরা সবাই যোগ্য মানুষ চাচ্ছি, তবে যোগ্য মানুষটি আমার দলের হতে হবে। অনেকে আবার নিরপেক্ষ চাচ্ছেন, তবে নিরপেক্ষটি একটু আমার পক্ষে হতে হবে। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা সময়।’ (সূত্র: প্রথম আলোতে প্রকাশিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সুলতান মাহমুদের একটি নিবন্ধ।)
উপাচার্য মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালাতে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন, বোধকরি সে স¤পর্কেই কথাগুলো লিখেছেন। এর মধ্যে বর্তমান সময় স¤পর্কে তাঁর যে উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে, দেশের অধিকাংশ মানুষের উপলব্ধিও একই রকম।
এই যে সময়ের ফের তা কীভাবে এবং কত দিনে বদলাবে তা নিয়ে জনগণ নিশ্চিত নয়। ফলে তাদের মধ্যে শঙ্কা-সংশয় বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি করছে না। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে তাঁরা অতিগুরুত্বপূর্ণ ছয়টি সেক্টরের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। আরো স্পষ্ট করে বললে গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা এখনো স¤পন্ন হয়নি। কিছু কিছু ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াকে। তবে এগুচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে বলেই আমরা আশা করি। তাতে রাষ্ট্র সংস্কার হলেও মানুষের মগজের সংস্কার হবে কি? মগজের সংস্কার না হলে কিন্তু কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। [সংকলিত]
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ