সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
বছরের শুরু থেকেই এবার আবহাওয়ার বৈরী আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত জনজীবন। দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুগিয়েছে দেশবাসীকে। শীত মৌসুমে ভোগাতে পারে বলে আশঙ্কা।
চলমান এসব সংকট নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুম-লী দূষণ অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে আবহাওয়ার খুবই বিরূপ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঘন ঘন আসছে। এতে মানুষের ভোগান্তিও বেশি। এক্সট্রিম ওয়েদার পার করেছি। এরপর অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি হাওরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চল, চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছে এগুলো খুব অল্প সময়েই হয়েছে, যেটা আকস্মিক বন্যা।
আমাদের দেশে এল-নিনোর প্রভাব ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। লা নিনার প্রভাবে আগামী বছর আরও বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। আগামী বছর আরও বেশি বন্যা এবং তাপমাত্রার ঝুঁকি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাশাপাশি উজানেও অল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ঋতুগুলোর দৈর্ঘ্য কমে আসছে। দেশে শীত মৌসুম খুব স্বল্পদৈর্ঘ্য হয়ে গেছে। গ্রীষ্ম মৌসুম তুলনামূলক বেড়েছে, বর্ষার সময়টা কমেছে। কিন্তু অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বৃষ্টি বা কৃষি উপযোগী বৃষ্টির অনুপস্থিতি রয়েছে। এগুলো আমাদের প্রকৃতিকে বৈরী পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দুর্যোগের মুখোমুখি করছে।
আহমেদ কামরুজ্জামান আরও বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বিশ্বজুড়ে। ফলে একের পর এক হিটওয়েভ (তাপপ্রবাহ), কোল্ডওয়েভ (শৈত্যপ্রবাহ), ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরে ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। এগুলো সব আবার কাক্সিক্ষত। কোনোটি খুব বেশি অনাকাক্সিক্ষত নয়। এসব আভাস আগে থেকে জানা ছিল।
তিনি বলেন, এবার গ্রীষ্মকালে গরম ছিল। এক্সট্রিম ওয়েদারের যে ট্রেন্ড চলছে, এবছর আশঙ্কা করা হচ্ছে শীতের পরিমাণও অনেক বেশি থাকবে। কোল্ডওয়েভের সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের দিকে যখন বন্যা হতো তখন মানুষ বেশি মারা যেত। এখন মানুষ কম মারা গেলেও কৃষিজমি থেকে শুরু করে শিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব দুদিন স্থায়ী হয়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেশি বেশি নি¤œচাপ সৃষ্টির ফলে রেকর্ড বৃষ্টি হচ্ছে, বন্যাও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরের বন্যায় গত দুই মাস লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। তবে দুর্যোগ স্থায়ী হওয়ার পেছনে মানবসৃষ্ট কারণও রয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির শেষ নেই। আমাদের শিল্প উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, গবাদি পশু উৎপাদন, সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। একইভাবে মানব শরীরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চলমান দুর্যোগে এল-নিনো ও লা-নিনার প্রভাব কেমন - এই প্রশ্নের জবাবে আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, হিটওয়েভের ফলে দেশে হিটস্ট্রোক বেড়েছে। এবছর টানা ৮ থেকে ৯ দিন কোল্ডওয়েভ (শৈত্যপ্রবাহ) ছিল। হিটওয়েভ ছিল প্রায় ২৬ দিনের বেশি। ১৯৯৫ সালের ১ মে আমাদের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৯ বছর পর এবছর সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। এছাড়া এবার এপ্রিল মাসে টানা ২৬ দিন যে তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। যেগুলো অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এবছর এল-নিনো শেষ হয়ে নিউট্রাল অবস্থায় রয়েছে এবং লা নিনার আগমন হচ্ছে। ফলে এবছর যে নোয়াখালী, কক্সবাজার, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরে অতিমাত্রায় বৃষ্টি হচ্ছে, এই বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসটি আগেই দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে এল-নিনোর প্রভাব ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। লা নিনার প্রভাবে আগামী বছর আরও বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। আগামী বছর আরও বেশি বন্যা এবং তাপমাত্রার ঝুঁকি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এল নিনো-লা নিনার কিংবা প্রকৃতির বৈরী প্রভাব কাটিয়ে উঠতে করণীয় কী বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণে আমরা বেশি বেশি দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি। প্রকৃতির প্রভাব আমরা ঠেকাতে পারবো না। তবে স্থানীয়ভাবে জলাধার সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ বাড়ানো, শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখা, ভবন নির্মাণে চারপাশ খালি রাখা, জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনা দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়ানো ও দূষণ-দখল বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, এবার গ্রীষ্মকালে গরম ছিল। এক্সট্রিম ওয়েদারের যে ট্রেন্ড চলছে, এবছর আশঙ্কা করা হচ্ছে শীতের পরিমাণও অনেক বেশি থাকবে। কোল্ডওয়েভের সম্ভাবনা রয়েছে।