শামস শামীম ::
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুর্গম হাওরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছে ‘দাস পার্টি’ ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করার শপথ গ্রহণকারী হাওরের বিশেষ গেরিলা দল জুলাই মাসেই হানাদারদের নৌ চলাচল লাইফলাইন ভেঙে দিয়েছিল। নৌপথে দাসপার্টি হয়ে ওঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। তাই জুলাই মাসেই এই অঞ্চলে নৌচলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে পাকিস্তানিরা। নানা ফাঁদ পেতে ষড়যন্ত্র করেও অপ্রতিরোধ্য দাসপার্টিকে কাবু করতে পারেনি তারা। তবে ফাঁদে ফেলে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মাথা উঁচু করে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই করে খৈয়াগুপি বিলে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস। সম্প্রতি এসবই স্মৃতিচারণ করে একাত্তরে ফিরে গিয়েছিলেন দিরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও উপজেলা বিএনপির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম। তিনি দাস পার্টির প্রথম সারির একজন সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চৌকস গেরিলা দল দাসপার্টির মৃত্যুঞ্জয়ী কমান্ডার ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। যাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা ছিল। পরবর্তীতে মৃত্যুঞ্জয়ী কমান্ডারকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এ নিয়ে এখনো হতাশ ও ক্ষুব্ধ দাস পার্টির সদস্য আব্দুল কাইয়ুম।
দাসপার্টির অকুতোভয় যোদ্ধা দিরাই উপজেলা শহরের চন্ডিপুরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম।
রাজনীতি সচেতন পরিবারের এই তরুণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ থেকেই মাতৃভূমি রক্ষার শপথ নেন। টেকেরঘাট সাবসেক্টরের ৫ম ব্যাচের এই যোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যেতির দাসপার্টির একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আরো দুই কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গেও আলাদাভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। অস্ত্রহাতে সম্মুখযুদ্ধ করার পাশাপাশি দিরাই, জগন্নাথপুরসহ বিভিন্ন থানার তথ্য গোয়েন্দাদের মতো রেকি করে সাব সেক্টরে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আব্দুল কাইয়ুমের গায়েবানা জানাজাও হয়েছিল বালাট সাবসেক্টরের হেডকোয়ার্টারের এক এলাকায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বিজয়ের বেশে ফিরলেও তার দলের কোম্পানি কমান্ডার জগৎজ্যোতির মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখনো দাসের মৃত্যুতে আফসোস করেন। এই স্মৃতি মনে হলে দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। বেদনায় মুষড়ে পড়েন তিনি। জগৎজ্যোতির সঙ্গে শেষ যুদ্ধেও সঙ্গী ছিলেন তিনি।
চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তৃতীয় আব্দুল কাইয়ুম ১৯৭০ সালে এসএসসি পাশ করেন দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তার বড়ভাই তরুণ আব্দুল কদ্দুছ তখন দিরাইয়ের উদীয়মান প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কাইয়ুম নিজেও ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকেই তিনি মিছিল-মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খলিফা খ্যাত ছাত্রনেতাদের বাংলার সচেতন ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
দিরাইয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের স্থানীয় দোসররা বসতঘর ও বাজারের দোকান লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ঘরের টিন খুলে নেয়। আব্দুল কাইয়ুম দেশ স্বাধীন করে বিজয়ের বেশে ফিরে দেখেন বসতবাড়ি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করেন পরিবারের সবাই। তবে দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফিরেছেন এই ভাবনায় মনোবল অটুট ছিল। ভারতে ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে ৫ম ব্যাচের ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো আব্দুল কাইয়ুমের দাসপার্টির সবাই। এই ব্যাচের দুর্গম হাওর এলাকার গতি-প্রকৃতি বুঝে এমন তরুণদের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যাচের সফলভাবে ট্রেনিং সম্পন্নকারী তরুণদের মধ্যে ৩৬ জনকে দাসপার্টির জন্য আলাদাভাবে বাছাই করা হয়েছিল। দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র জগৎজ্যোতি দাসকে। ইংরেজি ও হিন্দিতে পারদর্শী হওয়ায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ রপ্ত করেন দাস। ভারতীয় আর্মিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে চোতপাত করলে বা বাঙালি বিরোধী কথা বার্তা বললে তাদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে ছাড় দিতেন না দেশপ্রেমিক জগৎজ্যোতি দাস। ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ পেয়ে আরো পোক্ত হন জ্যোতি। কমান্ডারের নজরে পড়ে তার পারদর্শিতা। পরে জগৎজ্যোতিকে প্রধান করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী গেরিলা বাহিনী ‘দাস পার্টি’। এই পার্টির সাহসী সদস্য হিসেবে বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে নামেন আব্দুল কাইয়ুম। দাস পার্টির অভিযান দিয়ে শুরু করে শেষ করেন কমান্ডারের শেষ যুদ্ধ দিয়ে একই বাহিনীর হয়ে। শেষ যুদ্ধেই কমান্ডারকে হারিয়েছিলেন তিনি। একসঙ্গে কুড়ি বলনপুর থেকে অভিযানে বের হলেও কমান্ডারকে ছাড়াই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলের কতিপয় সদস্যের সঙ্গে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন আব্দুল কাইয়ুম।
আব্দুল কাইয়ুম জানান, দাসপার্টির তরুণদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাবসেক্টর টেকেরঘাট সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়েছেন তরুণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিছুদিন পরে মেজর মুসলেহ উদ্দিন অধিনায়ক হয়ে আসেন। ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন ভাট ও বার্মা জগৎজ্যোতিসহ টেকেরঘাট সাবসেক্টরের যোদ্ধাদের বিশেষ তত্ত্বাবধান করেন। শিখিয়ে দেন রণকৌশল। হাওর-ভাটি শত্রুমুক্ত রাখার শপথ করেন দাসপার্টির গেরিলারা। সাহসে, সংকল্পে তারা সবাই ছিলেন তেজি।
ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে বালাট হয়ে টেকেরঘাটে ফিরেছিলেন আব্দুল কাইয়ুম। তাদেরকে হাওরাঞ্চলের নৌপথে হানাদারদের লাইফলাইন ভেঙে দেওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সিলেট থেকে সড়কপথে হানাদার বাহিনী হাওরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে নৌপথ ব্যবহার করতো। শেরপুর তখন ছিল গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুট।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জয়কলস সেতু ধ্বংস করতে রাজাকারদের বাধার মুখে পড়ে গতিপথ বদলে পাশের সদরপুর সেতু উড়িয়ে দেয় দাস পার্টি। সাবসেক্টর কমান্ডারসহ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার মেজর বাথের সঙ্গে পরামর্শ করে জগৎজ্যোতি সদরপুর সেতু ধ্বংস করার অভিযানে নামেন আব্দুল কাইয়ুমসহ ২০ জনের অধিক যোদ্ধাদের নিয়ে। তখন জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। ছোট ছোট নৌকায় করে সেতুর কাছের একটি গ্রামে এসে অবস্থান করেন। রাত ১০টায় নানা কৌশল অবলম্বন করে সেতুর কাছে এসে এক পাশে প্রহরায় থাকা চার রাজাকারকে অস্ত্রসহ জিম্মি করেন। পরে বিস্ফোরক দিয়ে সদরপুর সেতু উড়িয়ে দিয়ে হানাদারদের সড়ক যোগাযোগ লাইন সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে দেন আব্দুল কাইয়ুমরা। টেকেরঘাট সাব সেক্টর থেকে হানাদার ও পাঞ্জাবিদের ফাঁকি দিয়ে দাসপার্টি সদরপুর সেতু ধ্বংস করতে এসে সফল অভিযান চালিয়ে ফিরেছিল। সুনামগঞ্জের এই সেতু ব্যবহার করে সিলেট ও ছাতক থেকে হানাদাররা সহজে যাতায়াত করতো। কয়েকটি নৌকা করে টেকেরঘাট থেকে দুর্গম হাওর, নদী ও খাল পেরিয়ে রাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থান নিয়ে পরে অভিযানে নেমে সাহসের সঙ্গে দাস পার্টি অভিযান শেষ করেছিল। আব্দুল কাইয়ুম সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে জানান, তারা সেতুর কাছে আসেন তখন দুই তীরে পাহারা দিচ্ছিল সশস্ত্র রাজাকার দল। তখন রাত ১০টা হবে। দুর্গম হাওরে পোকা-মাকড়ের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না। ফাঁদ পেতে তাদেরকে আটক করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেন জগৎজ্যোতি। দুই পাশের রাজাকারদের মধ্যে একপাড়ের চারজনকে জিম্মি করে আগেই সেতুতে বিস্ফোরক বেঁধে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অভিযান সম্পন্ন করে আর বিলম্ব করেননি সদরপুরে। আব্দুল কাইয়ুমসহ অন্যরা নিচেই নৌকা বেয়ে প্রতিকূল হাওর পাড়ি দিয়ে টেকেরঘাটে পৌঁছে রিপোর্ট করেন। দাসপার্টি সিলেট ও ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ শহরে সহজ যাতায়াত নিশ্চিত করা হানাদারদের যোগাযোগ লাইন ভেঙে দেয় সদরপুর সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে। এই অভিযানের পর আব্দুল কাইয়ুমের বাহিনী তথা দাসপার্টিকে অভিনন্দন জানানো হয় সাবসেক্টর থেকে। দাস পার্টিকে এরপর বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তাদের অনিষ্ট করার পরিকল্পনা করে হানাদার ও রাজাকাররা। সদরপুর সেতু ধ্বংসের অভিযান শেষে আব্দুল কাইয়ুমকে কম্পানি কমান্ডার আব্দুস সালামের দলে যুক্ত করা হয়।
আগস্ট মাসে নবীগঞ্জ থানায় অভিযানে যান তিনি। অভিযান চালিয়ে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর খবর পেয়ে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা পালিয়ে যায়। এই অভিযান প্রশংসিত হন টেকেরঘাট সাবসেক্টর কর্মকর্তাদের কাছে। সফল অভিযান শেষে আব্দুল কাইয়ুম আবারও টেকেরঘাটে ফিরে আসেন। বিশ্রাম নেন কয়েকদিন। টেকেরঘাট থেকে আবার জগন্নাথপুরে রেকি করতে আসেন কোম্পানি কমান্ডার নূরুল ইসলামের দলের সঙ্গে। সেখানে ক্যাম্প করে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। গোয়েন্দাদের মতো নানা বেশ নিয়ে দেশদ্রোহীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন। পরে তা পৌঁছে দিতেন সাবসেক্টরে। জগন্নাথপুর অবস্থানকালেই পাঞ্জাবিরা জগন্নাথপুর দখল করে নেয়। এখান থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে কমান্ডার তাদেরকে নিয়ে দিরাই চলে আসেন। দিরাইও তখন দখল নেয় হানাদার বাহিনী। আব্দুল কাইয়ুম চরনারচর হয়ে টেকেরঘাট সাবসেক্টরে চলে আসেন।
পরে নভেম্বরে আবার দাসপার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। দাসপার্টি তখন পাক্কা গেরিলা দলে পরিণত হয়েছে। সম্মুখযুদ্ধ, সেতু ধ্বংস, বার্জ ধ্বংস, থানা দখল করে অস্ত্র সংগ্রহ, রাজাকার-দালাল ধরে আনাসহ নানা অভিযান চালিয়ে প্রশংসিত হচ্ছিল। এই বাহিনীর সুনাম নিয়ে তখন বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদও প্রচারিত হয়েছিল। দুর্গম হাওরে অভিযানকালে দাসপার্টি বিভিন্ন সময়ে হাওরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কুড়ি বলনপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকেই একাধিক অভিযান পরিচালনা করে দাসপার্টি। কুড়ি বলনপুর থেকে দাসপার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি বানিয়াচং আজমিরি অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে পিটুয়াকান্দা এলাকায় পাঞ্জাবির এম্বুশে পড়েন। এসময় একজন স্থানীয় লোক খবর দিয়েছিল পিটুয়াকান্দায় রাজাকার ক্যাম্প আছে। রাজাকাররা মানুষদের নির্যাতন করছে। হাওরের পানি তখন কমে আসছিল। দেশপ্রেমিক জ্যোাতি তার কথায় বিশ্বাস করে রাজাকারদের ধরতে রওয়ানা দেন। সঙ্গে যায় ইলিয়াস, গোপেন্দ্রসহ কয়েকজন। আব্দুল কাইয়ুমসহ অন্যরা পিটুয়াকান্দাতেই অবস্থান করেন। মূল দল থেকে ছিটকে পড়েন জ্যোতি। এই সুযোগে আজমিরি ও শাল্লা থেকে রাজাকার ও পাঞ্জাবিরা জগৎজ্যোতিকে ঘিরে ফেলে। দাসপার্টির অন্য সদস্যরাও এম্বুশের মুখে পড়ে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। অন্যদিকে খৈয়াগুপি বিলে হানাদার ও রাজাকারদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছিল জগৎজ্যোতির। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করে সন্ধ্যার দিকে শহীদ হন জগৎজ্যোতি।
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দিনটি ছিল ১৬ নভেম্বর। সন্ধ্যার আগে শহীদ হন জগৎজ্যোতি। অধিনায়কের সঙ্গী আহত ইলিয়াস কোনও রকমে পালিয়ে এসে খবর দেন আব্দুস কাইয়ুমসহ অন্যদের। এই খবরে দাসপার্টির সবাই মুষড়ে পড়েন। কাইয়ুম নির্বাক হয়ে যান। সকালে যার সঙ্গে যুদ্ধ কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন, নানা পরিকল্পনা করেছেন আজ তিনি নেই। অধিনায়ককে হারিয়ে এম্বুশের মুখে পড়ে কুড়ি বলনপুরে চলে আসেন আব্দুল কাইয়ুমরা। নভেম্বরে খৈয়াগুপি বিলের পাশে দাসপার্টির কমান্ডারের এই যুদ্ধ সম্পর্কে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, হাওরের পানি তখন কমে আসছে। নৌকা চলছেনা। একটি খালের তীরে নৌকা রেখে আমরা অবস্থান করছিলাম। রাজাকারদের ধাওয়া করে জ্যোতি দ্রুত চলে যান। শাল্লা ও আজমিরিগঞ্জ থানা থেকে পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা আমাদের ঘেরাও করে। ওইদিন আমাদের বেঁচে ফেরার কথা না। যদি জগৎজ্যোতি তাদের প্রতিরোধ না করতেন, জগৎজ্যোতির সঙ্গে যুদ্ধ না হতো তাহলে পুরো বাহিনীকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতো পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা। এটাই ছিল শেষ যুদ্ধ। পরে টেকেরঘাট চলে আসেন তিনি। এর আরো পরে টেকেরঘাট থেকে সাচনা চলে আসেন। এখানেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উদযাপন করেন। পরে সুনামগঞ্জ শহরে এসে কলেজ হোস্টেলে ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এখান থেকেই বাড়ি ফিরেন যুদ্ধজয়ী আব্দুল কাইয়ুম।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ায় আব্দুল কাইয়ুমদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। লুটপাট করা হয়েছিল বসতবাড়ির সব কিছু। দোকানের টিন খুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা। দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে আবার পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বর্তমানে দিরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল কাইয়ুম। এক দশকের বেশি দিরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আশির দশকে দিরাইয়ে সাংবাদিকতায়ও যুক্ত ছিলেন। দিরাই প্রেসক্লাব গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
টেকেরঘাট সাবসেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুস সালাম বলেন, আব্দুল কাইয়ুম দাসপার্টির পাশাপাশি আমার কোম্পানিতেও সম্মুখযুদ্ধ করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনি। আমার কোম্পানির অনেক সফল অভিযানের হিরো তিনি। মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করার শপথে বলিয়ান এই যোদ্ধা এখনো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে নানা কাজে সম্পৃক্ত আছেন।
আব্দুল কাইয়ুম আরো বলেন, আমি এখনো জগৎজ্যোতি দাসের মৃত্যুটা ভুলতে পারছিনা। আমার চোখের সামনে দিয়ে রাজাকারদের ধাওয়া করে আর ফিরে আসলনা। যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো। পরে তার নিথর দেহেও পাঞ্জাবি ও রাজাকাররা আঘাত করে খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিল। সেসব কথা শুনে এখনো ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওইদিন বাহিনীর সবাই শহীদ হতে পারতাম। তার সঙ্গে আমরা গেলে একই পরিণত হতো। কিন্তু অকুতোভয় যোদ্ধা মূল অভিযানের আগে রাজাকার ধরার অভিযানে গিয়ে ফাঁদে পড়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, যতক্ষণ জ্যোতির শক্তি ও অস্ত্র ছিল ততক্ষণ লড়াই করেছে। আমরা হানাদারদের উন্নত সমরাস্ত্রের মুখে হানাদার ও রাজাকারদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ফিরে আসবো এটা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু দাসের সাহসের কারণে রাজাকার ও খানসেনাদের ধাওয়া করায় আমরা নিরাপদে পুরো বাহিনী নিয়ে ফিরে আসতে পারি। আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমরা তার জন্য কিছু করতে পারিনি।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না উল্লেখ করে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন অহেতুক বিতর্ক করছে বিভিন্ন দল। তবে বাস্তবতা হলো এই ভূখন্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড়ো কোন অর্জন নাই। আমার দল বিএনপিতে এখনো প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তারা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। না হলে আমাদের আত্মপরিচয়ই সংকটে পড়বে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুর্গম হাওরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছে ‘দাস পার্টি’ ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করার শপথ গ্রহণকারী হাওরের বিশেষ গেরিলা দল জুলাই মাসেই হানাদারদের নৌ চলাচল লাইফলাইন ভেঙে দিয়েছিল। নৌপথে দাসপার্টি হয়ে ওঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। তাই জুলাই মাসেই এই অঞ্চলে নৌচলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে পাকিস্তানিরা। নানা ফাঁদ পেতে ষড়যন্ত্র করেও অপ্রতিরোধ্য দাসপার্টিকে কাবু করতে পারেনি তারা। তবে ফাঁদে ফেলে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মাথা উঁচু করে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই করে খৈয়াগুপি বিলে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস। সম্প্রতি এসবই স্মৃতিচারণ করে একাত্তরে ফিরে গিয়েছিলেন দিরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও উপজেলা বিএনপির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম। তিনি দাস পার্টির প্রথম সারির একজন সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চৌকস গেরিলা দল দাসপার্টির মৃত্যুঞ্জয়ী কমান্ডার ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। যাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা ছিল। পরবর্তীতে মৃত্যুঞ্জয়ী কমান্ডারকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এ নিয়ে এখনো হতাশ ও ক্ষুব্ধ দাস পার্টির সদস্য আব্দুল কাইয়ুম।
দাসপার্টির অকুতোভয় যোদ্ধা দিরাই উপজেলা শহরের চন্ডিপুরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম।
রাজনীতি সচেতন পরিবারের এই তরুণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ থেকেই মাতৃভূমি রক্ষার শপথ নেন। টেকেরঘাট সাবসেক্টরের ৫ম ব্যাচের এই যোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যেতির দাসপার্টির একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আরো দুই কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গেও আলাদাভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। অস্ত্রহাতে সম্মুখযুদ্ধ করার পাশাপাশি দিরাই, জগন্নাথপুরসহ বিভিন্ন থানার তথ্য গোয়েন্দাদের মতো রেকি করে সাব সেক্টরে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আব্দুল কাইয়ুমের গায়েবানা জানাজাও হয়েছিল বালাট সাবসেক্টরের হেডকোয়ার্টারের এক এলাকায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বিজয়ের বেশে ফিরলেও তার দলের কোম্পানি কমান্ডার জগৎজ্যোতির মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখনো দাসের মৃত্যুতে আফসোস করেন। এই স্মৃতি মনে হলে দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। বেদনায় মুষড়ে পড়েন তিনি। জগৎজ্যোতির সঙ্গে শেষ যুদ্ধেও সঙ্গী ছিলেন তিনি।
চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তৃতীয় আব্দুল কাইয়ুম ১৯৭০ সালে এসএসসি পাশ করেন দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তার বড়ভাই তরুণ আব্দুল কদ্দুছ তখন দিরাইয়ের উদীয়মান প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কাইয়ুম নিজেও ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকেই তিনি মিছিল-মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খলিফা খ্যাত ছাত্রনেতাদের বাংলার সচেতন ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
দিরাইয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের স্থানীয় দোসররা বসতঘর ও বাজারের দোকান লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ঘরের টিন খুলে নেয়। আব্দুল কাইয়ুম দেশ স্বাধীন করে বিজয়ের বেশে ফিরে দেখেন বসতবাড়ি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করেন পরিবারের সবাই। তবে দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফিরেছেন এই ভাবনায় মনোবল অটুট ছিল। ভারতে ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে ৫ম ব্যাচের ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো আব্দুল কাইয়ুমের দাসপার্টির সবাই। এই ব্যাচের দুর্গম হাওর এলাকার গতি-প্রকৃতি বুঝে এমন তরুণদের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যাচের সফলভাবে ট্রেনিং সম্পন্নকারী তরুণদের মধ্যে ৩৬ জনকে দাসপার্টির জন্য আলাদাভাবে বাছাই করা হয়েছিল। দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র জগৎজ্যোতি দাসকে। ইংরেজি ও হিন্দিতে পারদর্শী হওয়ায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ রপ্ত করেন দাস। ভারতীয় আর্মিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে চোতপাত করলে বা বাঙালি বিরোধী কথা বার্তা বললে তাদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে ছাড় দিতেন না দেশপ্রেমিক জগৎজ্যোতি দাস। ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ পেয়ে আরো পোক্ত হন জ্যোতি। কমান্ডারের নজরে পড়ে তার পারদর্শিতা। পরে জগৎজ্যোতিকে প্রধান করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী গেরিলা বাহিনী ‘দাস পার্টি’। এই পার্টির সাহসী সদস্য হিসেবে বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে নামেন আব্দুল কাইয়ুম। দাস পার্টির অভিযান দিয়ে শুরু করে শেষ করেন কমান্ডারের শেষ যুদ্ধ দিয়ে একই বাহিনীর হয়ে। শেষ যুদ্ধেই কমান্ডারকে হারিয়েছিলেন তিনি। একসঙ্গে কুড়ি বলনপুর থেকে অভিযানে বের হলেও কমান্ডারকে ছাড়াই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলের কতিপয় সদস্যের সঙ্গে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন আব্দুল কাইয়ুম।
আব্দুল কাইয়ুম জানান, দাসপার্টির তরুণদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাবসেক্টর টেকেরঘাট সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়েছেন তরুণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিছুদিন পরে মেজর মুসলেহ উদ্দিন অধিনায়ক হয়ে আসেন। ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন ভাট ও বার্মা জগৎজ্যোতিসহ টেকেরঘাট সাবসেক্টরের যোদ্ধাদের বিশেষ তত্ত্বাবধান করেন। শিখিয়ে দেন রণকৌশল। হাওর-ভাটি শত্রুমুক্ত রাখার শপথ করেন দাসপার্টির গেরিলারা। সাহসে, সংকল্পে তারা সবাই ছিলেন তেজি।
ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে বালাট হয়ে টেকেরঘাটে ফিরেছিলেন আব্দুল কাইয়ুম। তাদেরকে হাওরাঞ্চলের নৌপথে হানাদারদের লাইফলাইন ভেঙে দেওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সিলেট থেকে সড়কপথে হানাদার বাহিনী হাওরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে নৌপথ ব্যবহার করতো। শেরপুর তখন ছিল গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুট।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জয়কলস সেতু ধ্বংস করতে রাজাকারদের বাধার মুখে পড়ে গতিপথ বদলে পাশের সদরপুর সেতু উড়িয়ে দেয় দাস পার্টি। সাবসেক্টর কমান্ডারসহ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার মেজর বাথের সঙ্গে পরামর্শ করে জগৎজ্যোতি সদরপুর সেতু ধ্বংস করার অভিযানে নামেন আব্দুল কাইয়ুমসহ ২০ জনের অধিক যোদ্ধাদের নিয়ে। তখন জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। ছোট ছোট নৌকায় করে সেতুর কাছের একটি গ্রামে এসে অবস্থান করেন। রাত ১০টায় নানা কৌশল অবলম্বন করে সেতুর কাছে এসে এক পাশে প্রহরায় থাকা চার রাজাকারকে অস্ত্রসহ জিম্মি করেন। পরে বিস্ফোরক দিয়ে সদরপুর সেতু উড়িয়ে দিয়ে হানাদারদের সড়ক যোগাযোগ লাইন সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে দেন আব্দুল কাইয়ুমরা। টেকেরঘাট সাব সেক্টর থেকে হানাদার ও পাঞ্জাবিদের ফাঁকি দিয়ে দাসপার্টি সদরপুর সেতু ধ্বংস করতে এসে সফল অভিযান চালিয়ে ফিরেছিল। সুনামগঞ্জের এই সেতু ব্যবহার করে সিলেট ও ছাতক থেকে হানাদাররা সহজে যাতায়াত করতো। কয়েকটি নৌকা করে টেকেরঘাট থেকে দুর্গম হাওর, নদী ও খাল পেরিয়ে রাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থান নিয়ে পরে অভিযানে নেমে সাহসের সঙ্গে দাস পার্টি অভিযান শেষ করেছিল। আব্দুল কাইয়ুম সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে জানান, তারা সেতুর কাছে আসেন তখন দুই তীরে পাহারা দিচ্ছিল সশস্ত্র রাজাকার দল। তখন রাত ১০টা হবে। দুর্গম হাওরে পোকা-মাকড়ের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না। ফাঁদ পেতে তাদেরকে আটক করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেন জগৎজ্যোতি। দুই পাশের রাজাকারদের মধ্যে একপাড়ের চারজনকে জিম্মি করে আগেই সেতুতে বিস্ফোরক বেঁধে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অভিযান সম্পন্ন করে আর বিলম্ব করেননি সদরপুরে। আব্দুল কাইয়ুমসহ অন্যরা নিচেই নৌকা বেয়ে প্রতিকূল হাওর পাড়ি দিয়ে টেকেরঘাটে পৌঁছে রিপোর্ট করেন। দাসপার্টি সিলেট ও ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ শহরে সহজ যাতায়াত নিশ্চিত করা হানাদারদের যোগাযোগ লাইন ভেঙে দেয় সদরপুর সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে। এই অভিযানের পর আব্দুল কাইয়ুমের বাহিনী তথা দাসপার্টিকে অভিনন্দন জানানো হয় সাবসেক্টর থেকে। দাস পার্টিকে এরপর বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তাদের অনিষ্ট করার পরিকল্পনা করে হানাদার ও রাজাকাররা। সদরপুর সেতু ধ্বংসের অভিযান শেষে আব্দুল কাইয়ুমকে কম্পানি কমান্ডার আব্দুস সালামের দলে যুক্ত করা হয়।
আগস্ট মাসে নবীগঞ্জ থানায় অভিযানে যান তিনি। অভিযান চালিয়ে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর খবর পেয়ে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা পালিয়ে যায়। এই অভিযান প্রশংসিত হন টেকেরঘাট সাবসেক্টর কর্মকর্তাদের কাছে। সফল অভিযান শেষে আব্দুল কাইয়ুম আবারও টেকেরঘাটে ফিরে আসেন। বিশ্রাম নেন কয়েকদিন। টেকেরঘাট থেকে আবার জগন্নাথপুরে রেকি করতে আসেন কোম্পানি কমান্ডার নূরুল ইসলামের দলের সঙ্গে। সেখানে ক্যাম্প করে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। গোয়েন্দাদের মতো নানা বেশ নিয়ে দেশদ্রোহীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন। পরে তা পৌঁছে দিতেন সাবসেক্টরে। জগন্নাথপুর অবস্থানকালেই পাঞ্জাবিরা জগন্নাথপুর দখল করে নেয়। এখান থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে কমান্ডার তাদেরকে নিয়ে দিরাই চলে আসেন। দিরাইও তখন দখল নেয় হানাদার বাহিনী। আব্দুল কাইয়ুম চরনারচর হয়ে টেকেরঘাট সাবসেক্টরে চলে আসেন।
পরে নভেম্বরে আবার দাসপার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। দাসপার্টি তখন পাক্কা গেরিলা দলে পরিণত হয়েছে। সম্মুখযুদ্ধ, সেতু ধ্বংস, বার্জ ধ্বংস, থানা দখল করে অস্ত্র সংগ্রহ, রাজাকার-দালাল ধরে আনাসহ নানা অভিযান চালিয়ে প্রশংসিত হচ্ছিল। এই বাহিনীর সুনাম নিয়ে তখন বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদও প্রচারিত হয়েছিল। দুর্গম হাওরে অভিযানকালে দাসপার্টি বিভিন্ন সময়ে হাওরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কুড়ি বলনপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকেই একাধিক অভিযান পরিচালনা করে দাসপার্টি। কুড়ি বলনপুর থেকে দাসপার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি বানিয়াচং আজমিরি অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে পিটুয়াকান্দা এলাকায় পাঞ্জাবির এম্বুশে পড়েন। এসময় একজন স্থানীয় লোক খবর দিয়েছিল পিটুয়াকান্দায় রাজাকার ক্যাম্প আছে। রাজাকাররা মানুষদের নির্যাতন করছে। হাওরের পানি তখন কমে আসছিল। দেশপ্রেমিক জ্যোাতি তার কথায় বিশ্বাস করে রাজাকারদের ধরতে রওয়ানা দেন। সঙ্গে যায় ইলিয়াস, গোপেন্দ্রসহ কয়েকজন। আব্দুল কাইয়ুমসহ অন্যরা পিটুয়াকান্দাতেই অবস্থান করেন। মূল দল থেকে ছিটকে পড়েন জ্যোতি। এই সুযোগে আজমিরি ও শাল্লা থেকে রাজাকার ও পাঞ্জাবিরা জগৎজ্যোতিকে ঘিরে ফেলে। দাসপার্টির অন্য সদস্যরাও এম্বুশের মুখে পড়ে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। অন্যদিকে খৈয়াগুপি বিলে হানাদার ও রাজাকারদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছিল জগৎজ্যোতির। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করে সন্ধ্যার দিকে শহীদ হন জগৎজ্যোতি।
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দিনটি ছিল ১৬ নভেম্বর। সন্ধ্যার আগে শহীদ হন জগৎজ্যোতি। অধিনায়কের সঙ্গী আহত ইলিয়াস কোনও রকমে পালিয়ে এসে খবর দেন আব্দুস কাইয়ুমসহ অন্যদের। এই খবরে দাসপার্টির সবাই মুষড়ে পড়েন। কাইয়ুম নির্বাক হয়ে যান। সকালে যার সঙ্গে যুদ্ধ কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন, নানা পরিকল্পনা করেছেন আজ তিনি নেই। অধিনায়ককে হারিয়ে এম্বুশের মুখে পড়ে কুড়ি বলনপুরে চলে আসেন আব্দুল কাইয়ুমরা। নভেম্বরে খৈয়াগুপি বিলের পাশে দাসপার্টির কমান্ডারের এই যুদ্ধ সম্পর্কে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, হাওরের পানি তখন কমে আসছে। নৌকা চলছেনা। একটি খালের তীরে নৌকা রেখে আমরা অবস্থান করছিলাম। রাজাকারদের ধাওয়া করে জ্যোতি দ্রুত চলে যান। শাল্লা ও আজমিরিগঞ্জ থানা থেকে পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা আমাদের ঘেরাও করে। ওইদিন আমাদের বেঁচে ফেরার কথা না। যদি জগৎজ্যোতি তাদের প্রতিরোধ না করতেন, জগৎজ্যোতির সঙ্গে যুদ্ধ না হতো তাহলে পুরো বাহিনীকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতো পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা। এটাই ছিল শেষ যুদ্ধ। পরে টেকেরঘাট চলে আসেন তিনি। এর আরো পরে টেকেরঘাট থেকে সাচনা চলে আসেন। এখানেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উদযাপন করেন। পরে সুনামগঞ্জ শহরে এসে কলেজ হোস্টেলে ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এখান থেকেই বাড়ি ফিরেন যুদ্ধজয়ী আব্দুল কাইয়ুম।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ায় আব্দুল কাইয়ুমদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। লুটপাট করা হয়েছিল বসতবাড়ির সব কিছু। দোকানের টিন খুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা। দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে আবার পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বর্তমানে দিরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল কাইয়ুম। এক দশকের বেশি দিরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আশির দশকে দিরাইয়ে সাংবাদিকতায়ও যুক্ত ছিলেন। দিরাই প্রেসক্লাব গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
টেকেরঘাট সাবসেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুস সালাম বলেন, আব্দুল কাইয়ুম দাসপার্টির পাশাপাশি আমার কোম্পানিতেও সম্মুখযুদ্ধ করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনি। আমার কোম্পানির অনেক সফল অভিযানের হিরো তিনি। মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করার শপথে বলিয়ান এই যোদ্ধা এখনো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে নানা কাজে সম্পৃক্ত আছেন।
আব্দুল কাইয়ুম আরো বলেন, আমি এখনো জগৎজ্যোতি দাসের মৃত্যুটা ভুলতে পারছিনা। আমার চোখের সামনে দিয়ে রাজাকারদের ধাওয়া করে আর ফিরে আসলনা। যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো। পরে তার নিথর দেহেও পাঞ্জাবি ও রাজাকাররা আঘাত করে খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিল। সেসব কথা শুনে এখনো ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওইদিন বাহিনীর সবাই শহীদ হতে পারতাম। তার সঙ্গে আমরা গেলে একই পরিণত হতো। কিন্তু অকুতোভয় যোদ্ধা মূল অভিযানের আগে রাজাকার ধরার অভিযানে গিয়ে ফাঁদে পড়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, যতক্ষণ জ্যোতির শক্তি ও অস্ত্র ছিল ততক্ষণ লড়াই করেছে। আমরা হানাদারদের উন্নত সমরাস্ত্রের মুখে হানাদার ও রাজাকারদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ফিরে আসবো এটা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু দাসের সাহসের কারণে রাজাকার ও খানসেনাদের ধাওয়া করায় আমরা নিরাপদে পুরো বাহিনী নিয়ে ফিরে আসতে পারি। আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমরা তার জন্য কিছু করতে পারিনি।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না উল্লেখ করে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন অহেতুক বিতর্ক করছে বিভিন্ন দল। তবে বাস্তবতা হলো এই ভূখন্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড়ো কোন অর্জন নাই। আমার দল বিএনপিতে এখনো প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তারা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। না হলে আমাদের আত্মপরিচয়ই সংকটে পড়বে।