তাহিরপুরের ট্যাকেরঘাট হাওর এলাকায় প্লাস্টিক, পলিথিন ও কাঁচের বোতলে ভরে যাওয়া কৃষিজমির যে করুণ চিত্র সামনে এসেছে, তা শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনের ওপর সরাসরি হুমকির বার্তা দিচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণধারার প্রসার এবং শত শত হাউসবোটের বিচরণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন রঙ যোগ করলেও একই সঙ্গে হাওরকে গ্রাস করছে ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ। এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে মূলত পর্যটকদের দায়িত্বহীনতা, হাউসবোট মালিকদের অবহেলা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের নজরদারির ঘাটতির কারণে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অন্তত ২০০ একর বোরো জমি প্লাস্টিক বর্জ্য ও ভাঙা কাঁচের বোতলে আক্রান্ত হয়ে কৃষিকাজ ব্যাহত করেছে। বীজতলা তৈরির মৌসুমে কৃষকদের পায়ে কাঁচের আঘাত লেগে কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে - এ দৃশ্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কৃষক সুরুজ মিয়ার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে তাদের অসহায়তা: “হাওরের বোরো জমি মদের বোতলে ভর্তি, হাতে কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কাটছে।”
যেখানে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশ বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এ ধরনের ব্যাঘাত পুরো হাওরাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
পরিবেশ সংগঠন ও স্থানীয়দের বক্তব্যেও উঠে এসেছে- হাউসবোট মালিকরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ম মানছে না, আর পর্যটকরাও নির্বিচারে প্লাস্টিক-গ্লাস পানিতে ফেলে দিচ্ছেন। যে হাওর জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি, প্রাকৃতিক জলাধার, দেশ-বিদেশের পর্যটনের আকর্ষণ - তার অস্তিত্ব এখন মানুষের বেপরোয়া আচরণের কাছে জিম্মি।
এ অবস্থায় প্রশাসনের কেবল অভিযান চালানোই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমাধান। প্রথমত, হাউসবোটগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনুমোদিত স্টোরেজ ও জমা কেন্দ্র ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পর্যটকবাহী নৌযানে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং জরিমানা কার্যকর করতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় পর্যটন ব্যবস্থায় ‘জিরো প্লাস্টিক’ নীতি চালুর পাশাপাশি বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। চতুর্থত, হাওর এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল ও স্থানীয় সংগঠনকে স¤পৃক্ত করে নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম চালু রাখা দরকার।
সান্ত¡নার বিষয়- জেলা প্রশাসক দ্রুত বর্জ্য অপসারণে উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের সমস্যা এক দিনের নয়; তাই এর সমাধানও একদিনে নয়। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং কঠোর বাস্তবায়ন।
হাওর আমাদের সম্পদ, দেশের জল-পাখি-কৃষির অভয়াশ্রম। পর্যটনকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতির সুরক্ষা অগ্রাধিকার হতে হবে- নয়তো একদিন পর্যটনের আনন্দই পরিণত হবে পরিবেশ ও কৃষির অভিশাপে। হাওরকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিন, নইলে ক্ষতির দায় এড়ানো যাবে না।