সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
দেশে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের কর্মকর্তারাই নিজেদের স্বার্থে সচিবালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছেন এক মাসের বেশি সময় ধরে। প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করছেন তদবিরকারী কর্মকর্তারা। মাঠ প্রশাসনেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন করছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসেও প্রশাসনে কাজের গতি ফেরেনি। এতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সচিবালয়ে অনেক কর্মকর্তা দাপ্তরিক কাজ ফেলে নিজেদের সুবিধা আদায় কিংবা অন্যের বদলি বা পদোন্নতি কীভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা নিজেরাই যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন, তাহলে তারা দেশের শৃঙ্খলা রক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন। কিন্তু শৃঙ্খলা ফেরাতে গত এক মাসে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে কঠোর কোনো বার্তা বা সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি কখনো। বিগত দেড় দশকে পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় বিবেচনা অগ্রাধিকার দিয়ে বৈষম্যের পাহাড় তৈরি করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। আর এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সময় লাগবে।
তারা আরও বলেন, জ্যেষ্ঠতা ও মেধা অনুযায়ী অবশ্যই পদোন্নতি দেওয়া জরুরি। তবে তাড়াহুড়ো করে পরিবর্তন কিংবা সংস্কার করা হলে এ নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হবে। বর্তমান সময়ে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত বঞ্চিতরাই যাতে সুবিধা পান, সেই বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ারও দাবি উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, অতীতে শুধু আওয়ামী মতাদর্শী না হওয়ার কারণে ২৮ থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসির সুপারিশ করা অনেক প্রার্থী নিয়োগ-বঞ্চিত হয়েছেন। ৮ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাঠ প্রশাসনকে জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলকভাবে গড়ে তোলার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনের ১৩৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জন যুগ্ম সচিব ও ১২০ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পাশাপাশি ১০ জন যুগ্ম সচিব, ৮ জন অতিরিক্ত সচিব ও ৬ জন সচিবকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতির সুযোগে অনেক অযোগ্যরাও সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। এমনকি কারও কারও বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পাশাপাশি পদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়ার ফলে মাথাভারী হচ্ছে প্রশাসন।
গত রবি ও সোমবার দুদিনে দেশের ৫৯ জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নতুন পদায়ন নিয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে নজিরবিহীন হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের ‘সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের’ ডিসি করা হয়েছে অভিযোগ তুলে ডিসি নিয়োগের দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানান বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। একপর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের দুই যুগ্ম সচিবকে কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। এ সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা তার মোবাইল ফোনে ওই হট্টগোলের দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করতে গেলে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ধস্তাধস্তিও হয়। কর্মকর্তাদের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুগ্ম সচিব আলী আযম পাশের কক্ষের টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাকে সেখান থেকে বের করেন।
ডিসি নিয়োগ ইস্যুতে নিজেদের দাবি আদায়ে গত বুধবারও সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বিক্ষোভের মুখে নবনিযুক্ত ডিসিদের মধ্যে আটজনের নিয়োগ বাতিল ঘোষণা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যে আট জেলার নবনিযুক্ত ডিসিদের নিয়োগ বাতিল হয়েছে, সেগুলো হলো লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ী।
এদিকে মঙ্গলবারের হট্টগোলের ঘটনায় স্বাস্থ্য সচিব এমএ আকমল হোসেন আজাদকে আহ্বায়ক করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় গত ১৩ আগস্ট। ওইদিন ১১৭ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে।
এর মধ্যে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, এরপর যুগ্ম সচিব ও সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগেও তারা ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে তিন ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন এবার।
এ ছাড়া ডিসি হিসেবে এবার নিয়োগ পাওয়া কোনো কোনো কর্মকর্তা বিগত সরকারের সময়ও মন্ত্রীদের একান্ত সচিব ছিলেন। কেউ কেউ ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারও কারও বিরুদ্ধে মাঠ প্রশাসনে ইউএনও এবং এডিসি থাকার সময় বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ সচিবের একান্ত সচিব ছিলেন।
অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা শুধু পদোন্নতি পাচ্ছেন। এতে শিক্ষা, তথ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। গত ৩১ আগস্ট তারা আন্তঃক্যাডার-বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামে একটি জোট ঘোষণা করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন।