বয়ানের রাজনীতি, বিভাজনের ফাঁদ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

আপলোড সময় : ২৯-১০-২০২৫ ০৮:২২:৪২ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২৯-১০-২০২৫ ০৮:২২:৪২ পূর্বাহ্ন
খালিদুর রহমান::> ইদানীং একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি- ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি না করতে পারলে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন।’ কথাটির ভেতরে বাস্তবতা আছে। কারণ রাজনীতির মঞ্চে কেবলমাত্র সৎ কাজ কিংবা নীতির ভিত্তিতে নয়, বরং গল্প, ব্যাখ্যা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের মনে দাগ কাটার মতো ব্যাখ্যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয়। যে দল বা নেতৃত্ব তার রাজনৈতিক দর্শনকে মানুষের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারে, তারাই অনেক সময় টিকে যায়। এ কারণেই ন্যারেটিভের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন ন্যারেটিভ সত্য ও ন্যায়ের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে; যখন ন্যারেটিভকে কেন্দ্র করে বিভাজন, প্রতিহিংসা এবং গোষ্ঠীগত রাজনীতি সমাজে শিকড় গেড়ে বসে। ন্যারেটিভ বাস্তবে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হলেও কখনোই প্রকৃত মুক্তি দেয় না। কারণ মুক্তি আসে ন্যায়নীতি, সুশাসন ও সততার মাধ্যমে। ন্যারেটিভের মাধ্যমে এক ধরনের আবেগ সৃষ্টি করা যায়, অস্থায়ীভাবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই ন্যারেটিভ সমাজকে বিভক্ত করে ফেলে। যে ন্যারেটিভ একদলকে একত্র করে, সেটিই অন্য দলকে শত্রুতে পরিণত করে। এভাবেই রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা ইতিহাসে দেখেছি, নানা ন্যারেটিভের জোরে দেশকে আন্দোলিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও একটি ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল- বাংলা ভাষা, জাতিগত পরিচয় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। সেই সময়ে ন্যারেটিভ একটি জাতিকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, স্বাধীনতার পর সেই ন্যারেটিভের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি; বরং বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। একসময়ের মুক্তির ন্যারেটিভ পরবর্তীকালে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, আর সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ কেবল বলপ্রয়োগ নয়; এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস এবং মতভেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এক কথায় বলা যায়, ন্যারেটিভের অপব্যবহারই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বারবার সংকটে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে আমরা যেসব নতুন ন্যারেটিভের বিস্তার দেখি- সেগুলো প্রায়শই ওয়েবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয়। এগুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের মনের গভীরে ঢুকে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব ন্যারেটিভের অনেকগুলোই তথ্যনির্ভর নয়; বরং এগুলো আবেগ ও বিভ্রান্তির ওপর দাঁড়ানো। ফলে সমাজে ক্ষেত্রবিশেষ ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে। এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষকে একেবারে অস্বীকার করে, তখন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয় তৈরি হয় না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জায়গায় তৈরি হয় সন্দেহ, প্রতিহিংসা ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। এভাবে চললে ব্যর্থতা বাড়তেই থাকবে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের উদ্যোগ না নেওয়ায় আজকের পরিবর্তিত বাংলাদেশে এক ধরনের নতুন ফ্যাসিবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জনগণকে বিভক্ত করে এমন নানা ধরনের আবেগঘন ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে, যা অনেক সময় জনরোষ উসকে দিয়ে মব জাস্টিসের রূপ নিচ্ছে। অথচ বাস্তবে আমাদের যা প্রয়োজন ছিল, তা - ন্যারেটিভ নয়, বরং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। বিভাজনের গল্প মানুষকে মুক্তি দেয় না; প্রকৃত মুক্তি আসে ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, মানসম্মত শিক্ষা ও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেসব প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হছে না। দুঃখজনকবাস্তবতা হলো, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই জনগণের কল্যাণমূলক কর্মকা-ে মনোযোগী না হয়ে কেবল ক্ষমতা অর্জনের জন্য ন্যারেটিভ তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। এর ফলে তাদেরমূল আদর্শ ম্লান হয়ে যায় এবং সামগ্রিকভাবে ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠী সুযোগ নিয়ে বিভাজনমূলক ও কৃত্রিম ন্যারেটিভ তৈরি করে নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক পরিসর দখলের চেষ্টা করে। যেন মূল বৃক্ষকে গলাচিপে ধরে আগাছার মতো বিস্তার লাভ করে চারপাশ ঢেকে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই বাস্তবতা আমাদের রাজনীতির অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। সততা, সমন্বয় ও উন্নয়নের দর্শনকে ন্যারেটিভের অস্ত্রে আচ্ছন্ন করার এক অবিরাম প্রচেষ্টা চলছে। অথচ আজকের বাংলাদেশে প্রশ্নটা কেবল ন্যারেটিভের অস্তিত্ব বা শক্তির নয়, বরং আমরা দেশ হিসেবে কোন পথে এগোতে চাই, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি বারবার বিভাজনের রাজনীতি চর্চা করে নিজেদেরকে দুর্বল করব, নাকি খোলা মনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ন্যায়নীতি ও অর্থনৈতিক মুক্তির একটি স্থায়ী পথ নির্মাণ করব? ন্যারেটিভভিত্তিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো- এটি সমাজে দীর্ঘস্থায়ী আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। ধীরে ধীরে মানুষ আর বুঝতে পারে না কোনটি সত্য আর কোনটি কেবল রাজনৈতিক গল্প। তখন গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। অথচ রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো জনগণের আস্থা - আস্থা যে তাদের কণ্ঠস্বর গুরুত্ব পাবে, তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তাদের জীবনমান ক্রমশ উন্নত হবে। কিন্তু রাজনীতি যদি বারবার শুধু ন্যারেটিভের জাল বুনতে থাকে, তাহলে সেই আস্থা আর ফিরে আসবে না। দেশের মানুষ চায় কর্মসংস্থান, আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তিতে দক্ষতা, বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের পরিবেশ। কিন্তু রাজনীতির মাঠে তারা দেখতে পায়- এক দল আরেক দলকে ধ্বংস করার জন্য ন্যারেটিভ ছড়াচ্ছে, অথচ দেশের বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান দিচ্ছে না। এর ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এখন সময় এসেছে ন্যারেটিভের বাইরে এসে বাস্তব উন্নয়নের রাজনীতি শুরু করার। আমাদের প্রয়োজন নতুন সামাজিক চুক্তি, যেখানে ন্যায়নীতি, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি হবে মূল ভিত্তি। রাজনীতিবিদরা যদি খোলা মনে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন, গঠনমূলক সমালোচনাকে গ্রহণ করেন এবং জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধানে একসঙ্গে কাজ করেন, তবেই প্রকৃত মুক্তি সম্ভব। অন্যথায় বিভাজনের ন্যারেটিভ কেবল আমাদের পিছিয়েই রাখবে। বাংলাদেশের মানুষ বৈচিত্র্যময়, কিন্তু তারা মূলত শান্তিপ্রিয় ও উন্নয়নমুখী। তারা চাইছে না নতুন বিভাজন, নতুন সংঘাত কিংবা নতুন ফ্যাসিবাদী প্রতিধ্বনি। তারা চায় এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ন্যায়নীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, অর্থনৈতিক মুক্তি বাস্তব রূপ নেবে এবং সবাই মিলেমিশে অগ্রগতির পথে হাঁটবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারলেই তা হবে আমাদের আগামী প্রজন্মের প্রতি প্রকৃত দায়িত্ব পালন।

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com