সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদী একসময় ছিল হাওরাঞ্চলের জীবনের অংশ - নদীর পাড়ে ফসল, জীবিকা আর পরিবেশের এক অনবদ্য ভারসাম্য। কিন্তু আজ সেই নদী পরিণত হয়েছে বালু লুটের হাটে। আদালতের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা’র আন্দোলন, স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ - সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান অবাধে নদী গিলছে ড্রেজার দিয়ে।
২০১৮ সালে আদালত ধোপাজানে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে। সেই আদেশ এখনও বহাল। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে “উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মাটিমিশ্রিত বালু উত্তোলনের অনুমতি”র নামে শুরু হয় সিলিকা বালুর বাণিজ্যিক লুট। উন্নয়ন প্রকল্পের অজুহাতে অনুমতি নিয়ে নদীর বুক থেকে কোটি কোটি টাকার সিলিকা বালু উঠছে, বিক্রি হচ্ছে, আর রাজস্বের নামে অসাধু কর্তাদের পকেট ভর্তি হচ্ছে।
এ দৃশ্য শুধু এক নদীর নয়, এটি পুরো ব্যবস্থার পচনধারার প্রতিচ্ছবি। আদালতের আদেশ অমান্য করা হচ্ছে, সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ নিজেই অবৈধ উত্তোলনের অনুমতি দিচ্ছে, প্রশাসনের নীরবতা যেন নৈতিক সহযোগিতায় পরিণত হয়েছে। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও স্বীকার করছেন, “অনুমতিপত্র দেখিয়ে কো¤পানি বালু তুলছে, তাই বাধা দিতে পারছি না।” প্রশ্ন হলো- একটি আদালতের আদেশ কি কেবল এক টুকরো কাগজ? সরকারের অনুমতি কি আদালতের রায়ের ঊর্ধ্বে?
অন্যদিকে, এই বালু লুটের শিকার হচ্ছে ধোপাজান-চলতি নদীর তীরবর্তী অন্তত ১৫টি গ্রাম। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ, কবরস্থান, হাটবাজার - সব নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। সাধারণ মানুষ বস্তা-বাঁশ দিয়ে ঘর টিকিয়ে রাখছে, অথচ নদীতে চলছে ড্রেজারের দানবীয় গর্জন। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, জমি ভাঙছে, অথচ রাষ্ট্রের নীতি নীরব।
আমরা জানতে চাই- কার স্বার্থে এই অনুমতি? কে দায় নেবে এই পরিবেশ ধ্বংসের? যদি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এই লুট চলে, তবে সেই উন্নয়ন প্রকৃতির কবরের উপর নির্মিত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের অনুমতি নয়, বরং এর তদন্তই হওয়া উচিত এখন।
‘লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ধোপাজান নদীকে “বালু ব্যবসার খনি” নয়, বরং “জীবন ও জীবিকার নদী” হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে হবে। আদালতের রায় বাস্তবায়ন, অবৈধ ড্রেজার জব্দ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি - এই তিন পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন।
একটি নদী যখন মরতে থাকে, তখন কেবল তার পানি হারায় না - হারায় মানুষের ন্যায়বোধ, প্রশাসনের জবাবদিহি ও রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তি। ধোপাজানের বালু শুধু নদী গিলে খাচ্ছে না, আমাদের বিবেকও খুবলে খাচ্ছে।