হাওরাঞ্চলে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন কার্যক্রমে অনিয়ম-অবহেলা কাম্য নয়

আপলোড সময় : ১৩-১০-২০২৫ ১২:০৪:১৭ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ১৩-১০-২০২৫ ১২:০৪:১৭ পূর্বাহ্ন
বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল হাওর অঞ্চলে বজ্রনিরোধক দন্ড- (লাইটনিং এরেস্টার) স্থাপন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দন্ড-গুলো এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে কাগজে কলমে সচল, মাঠে নয়। কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এর সুফল পাওয়া যায়নি। বরং একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি, স্থান নির্বাচন, মান নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া। হাওর এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশ্বের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চল। নাসার ২০১৭ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় হাওরাঞ্চলে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ৬ উপজেলায় প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৪টি বজ্রনিরোধক দন্ড- স্থাপন করা হয়। কিন্তু এই দন্ড-গুলো স্থাপিত হয়েছে মূল ঝুঁকিপূর্ণ খোলা হাওরভূমিতে নয়, বরং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বাজার বা বসতিপূর্ণ এলাকায় - যেখানে বজ্রপাতের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই কম। এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়, দ-গুলো সচল আছে কি না - তা যাচাইয়ের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট কোম্পানির। তারা আবার পরীক্ষা করেছে উপজেলা অফিসের “পিয়ন”কে সঙ্গে নিয়ে! এমন প্রহসনমূলক পরীক্ষাকে বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত বলা যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেরাও জানেন না দন্ড-গুলো কাজ করছে কি না। কোম্পানির পক্ষ থেকেও কেউ জানাতে পারেননি, এগুলোতে কী ধরনের সেন্সর বা প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে। অথচ প্রকল্পের নথিতে বলা আছে, দন্ড-গুলোর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড রাখার জন্য সেন্সর থাকা বাধ্যতামূলক। এখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একাধিক গুরুতর অনিয়ম চোখে পড়ে- প্রথমত, স্থান নির্বাচন ভুল ছিল। হাওরের খোলা মাঠ বা ফসল কাটার সময় কৃষক যেখানে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে মারা যান, সেখানে কোনও দন্ড- স্থাপন করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, মান যাচাই ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বছরে অন্তত একাধিকবার গ্রাউন্ডিং সিস্টেম পরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। দন্ড-গুলো সত্যিই বিদেশি নির্মিত কি না, তাও নিশ্চিত নয়। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের নাম করে কোটি টাকার সরকারি অর্থ খরচ হলেও বাস্তব উপকারে আসেনি। ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ উদ্যোগ জনস্বার্থ রক্ষার বদলে পরিণত হয়েছে দায়সারা মনোভাবে। সরকার যেখানে বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান খুঁজছে, সেখানে এমন নি¤œমানের বাস্তবায়ন গোটা উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা মনে করি- অবিলম্বে এই প্রকল্পের একটি স্বাধীন প্রযুক্তিগত তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত, যাতে প্রতিটি দন্ডের কার্যকারিতা, মান, স্থান এবং আর্থিক ব্যয় স্বচ্ছভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এছাড়া দন্ডগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে - যাতে জনগণ জানতে পারে আসলেই এগুলো কার্যকর কি না। পাশাপাশি ভবিষ্যতে নতুন করে কোনও দন্ড- স্থাপনের আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ পরামর্শ নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রকল্পে অনিয়ম বা গাফিলতি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। প্রকৃতপ্রস্তাবে বজ্রপাত প্রকৃতি-নির্ভর দুর্যোগ, কিন্তু মানবিক অবহেলা যদি প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয় - তাহলে সেটি আর প্রকৃতি নয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতা। হাওরবাসীর জীবন রক্ষার প্রশ্নে এমন “দ- নাটক” আর চলতে দেওয়া যায় না।

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com