শিশুযত্ন কেন্দ্র, পাঁচ ভুবনে বেড়ে উঠছে শিশুরা

আপলোড সময় : ১০-১০-২০২৫ ০৮:৩৬:০১ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ১০-১০-২০২৫ ০৮:৫৬:০৮ পূর্বাহ্ন
শহীদনূর আহমেদ ::
বুধবার সকালটা ছিল মেঘলা, শান্তিঞ্জের প্রত্যন্ত গাগলী গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় কানে ভেসে এলো শিশুদের সমবেত কণ্ঠে গান- “আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়, নিশ্চয়...”।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম গাগলী। চারপাশে পুকুর আর জলাশয়ে ভরা এলাকা। বর্ষাকালে এখানকার শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি খুব বেশি। সেই গ্রামের মধ্যেই একরকম নিরাপদ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গাগলী শিশুযত্ন কেন্দ্র। শিশুযত্ন কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর যেন জানিয়ে দিচ্ছিল, এ গ্রামে শৈশব আর শুধু ঝুঁকির নাম নয়, নিরাপত্তা ও স্বপ্নেরও নাম। জানা গেল, ছোট্ট গ্রাম গাগলীর চারদিক জলাশয়ে ঘেরা। বর্ষা এলে ডুবে যাওয়া এখানে নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় গ্রামটি কেঁদে উঠেছিল- যখন পাঁচ বছরের চাচাতো ভাইবোন মারিয়া ও সায়েম খেলতে খেলতে হারিয়ে যায়। সন্ধান করতে গিয়ে পাশের ডোবায় পাওয়া যায় তাদের নিথর দেহ। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। কৃষক শাহিদুর রহমান আজও ভুলতে পারেন না সেই দিন, সেদিন তিনি হারিয়েছিলেন তার কন্যা সায়েমাকে। এরপর ওই গ্রামে আইসিবিসি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠা করেন শিশুযত্ন কেন্দ্র। এই শিশুযত্ন কেন্দ্র এখন গ্রামের বাবা-মায়ের নির্ভরতার জায়গা।
শিশুদের পাঁচ ভুবন: সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ২৫ জন শিশু থাকে নিরাপদে। এখানে শুধু দেখাশোনাই হয় না, বরং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে থাকে নানা আয়োজন। কেন্দ্রের সুপারভাইজার মৌসুমী তালুকদার জানালেন, “আমরা শিশুদের পাঁচটি ভুবনের মাধ্যমে শেখাই, আপন ভুবন, গল্পের ভুবন, স্বপ্নের ভুবন, রঙিন ভুবন ও বাইরের ভুবন। এতে তারা খেলার ছলেই শিখে ফেলে। কেউ খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়লে ‘আপন ভুবন’-এ রাখা হয়।” এখানে প্রতিদিন খেলাধুলা, গান, ছড়া, গল্প বলা, আঁকাআঁকি, এমনকি সাঁতার শেখানোও হয়। যাতে শিশুরা শুধু আনন্দে সময় কাটায় না, বরং পানিতে নিরাপদ থাকতে শেখে। একজন যত্নকারী ও একজন সহকারী যত্নকারী প্রতিদিন শিশুদের দেখাশোনা করেন।
শাহিদুর রহমানের ছেলে মাহিম আহমদ এখন এই শিশুযত্ন কেন্দ্রেই বড় হচ্ছে। প্রতিদিন সন্তানকে এখানে রেখে কৃষক বাবার মন থাকে নিশ্চিন্ত।
গাগলী গ্রামের কৃষক শাহিদুর রহমান বলেন, ২০২২ সালের বন্যার পরে বাড়ি পাশে পানি জমে ছিল, সেখানে পড়ে আমার ৫ বছরের ছেলে ও সাড়ে ৫ বছরের ভাতিজি মারা যায়। আমরা বাচ্চাদের সম্পর্কে অসচেতন ছিলাম। আমাদের ভুলের কারণে আমাদের সন্তানরা পানিতে ডুবে মারা গেছে। শিশু যত্নকেন্দ্র হওয়ার পর থেকে আমরা নিশ্চিন্ত। পাড়ার ছেলেমেয়েরা এখানে নিরাপদ যত্নে বড় হচ্ছে।
গ্রামের গৃহবধূ নাজমা বেগম বললেন, আমার চার বছরের মেয়ে মাইশাকে সকালে দিয়ে যাই। সে এখানে খেলাধুলা করে, নতুন নতুন ছড়া শিখে। বাসায় এসে আমাকে বলেও শেখায়। আগে আমি কাজের সময় সবসময় চিন্তায় থাকতাম, এখন আর সেই দুশ্চিন্তা নেই। নতুন ভরসাস্থল: ২০২২ সালের সেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই গড়ে তোলা এই শিশুযতœ কেন্দ্র এখন গ্রামজুড়ে আশার আলো। অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে মাঠে কাজে যান, মায়েরা গৃহস্থালি সামলান, কারণ তারা জানেন তাদের সন্তান নিরাপদে আছে। সেদিন গাগলী শিশুযত্ন কেন্দ্রে ঢুকে দেখা গেল, দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা উৎসাহে ছড়া পড়ছে, খেলছে, গল্প শুনছে। বাইরে বৃষ্টি হলেও ভেতরে তাদের হাসি আর কোলাহল থেমে নেই।
জানা যায়, বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে এই কাজ বাস্তবায়ন করছে আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা। শিশুমৃত্যু হার কমানোর জন্য এই প্রকল্প সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জসহ ৩ উপজেলায় ৫০০টি শিশু যত্নকেন্দ্র রয়েছে। ফলে এসব কেন্দ্রে শিশুদের দিয়ে মায়েরা থাকেন নিশ্চিন্তে। প্রতিটি শিশুযত্ন কেন্দ্রে দুইজন ‘কেয়ার গিভার’ মায়ের স্নেহে শিশুদের যত্ন করছেন। তারা পাঁচ ভুবনে শিশুদের খেলার চলে শেখাচ্ছেন। রয়েছে গ্রামের অভিভাবকদের নিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি। এছাড়াও জেলায় ৫০টি জীবন রক্ষাকারী সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শেখানো হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ২১টি কৌশল। যেখানে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের এসব কৌশল শেখানো হয়। সাঁতার শিখতে পেরে খুশি শিশুরা।
সুমিং সুপারভাইজার কুলসুমা বেগম বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় আমরা শিশুদের ২১টি দক্ষতার মাধ্যমে সাঁতার শেখাচ্ছি। তারা কেবল সাঁতার শেখেনা তারা উদ্ধার বিষয়েও দক্ষতা অর্জন করছে।
আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা নির্বাহী পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় সুনামগঞ্জে ৫০০টি শিশু যত্নকেন্দ্র রয়েছে। যেখানে শিশুদের বিকাশ হচ্ছে। এই কেন্দ্রের শিশুরা অন্য শিশু থেকে আলাদা। তারা অনেকটা মেধাবী ও বিকশিত হয়। ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৫১ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে। যার ৭৫ শতাংশই শিশু। চলতি বছর সুনামগঞ্জে পানিতে ডুবে ২০ জনেরও বেশি মারা গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com