
আমীন আল রশীদ::
দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে মরিয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এমনকি এই প্রতীক না পেলে নির্বাচন ঠেকানোর হুমকিও দিয়েছেন দলটির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, কীভাবে প্রতীক আদায় করতে হয় সেটি তারা জানেন। এসব হুমকি-ধমকির মধ্যে নির্বাচন কমিশন সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, এনসিপি তো বটেই, কোনও দলকেই শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং এনসিপিকে নির্বাচন কমিশনের তালিকায় থাকা এমন কোনও প্রতীক চেয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে, যে প্রতীক কোনও নিবন্ধিত দলের নেই।
এনসিপি নতুন করে প্রতীক চেয়ে যে আবেদন করেছে সেখানেও তারা শাপলাই চেয়েছে। তাদের দাবি, প্রতীকের তালিকা সংশোধন করে হলেও তাদেরকে শাপলা দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, তাদের শাপলাই কেন চাই? নির্বাচন কমিশন কি এনসিপিকে ভয় পেয়ে তালিকা সংশোধন করে তাদেরকে শাপলা প্রতীক দেবে নাকি শাপলা না পেয়ে এনসিপি নির্বাচন প্রতিহত করবে বা করতে পারবে? নাকি এই প্রতীক জটিলতার মীমাংসায়ও প্রধান উপদেষ্টাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে?
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গত জুন মাসে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে- যেখানে তারা দলীয় প্রতীক চায় শাপলা। কিন্তু শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠে এই কারণে যে, শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। অতএব একটি দেশের জাতীয় প্রতীক কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হইতেছে উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা।’
অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের মূল বিষয় হচ্ছে শাপলা। তাকে ঘিরে থাকা ধানের শীষ, পাটগাছের পাতা ও তারকা হচ্ছে শাপলাকে ঘিরে থাকা নকশার অংশ। সেই হিসেবে দূর বা কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের দিকে তাকালে মনে হবে শাপলাই জাতীয় প্রতীক। বিতর্কটা এ কারণেই। প্রশ্ন হলো, জাতীয় প্রতীকের অংশ ‘ধানের শীষ’ বিএনপির প্রতীক বলেই কি শাপলার ব্যাপারে এনসিপির এত আগ্রহ?
এরকম বাস্তবতায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের বরাদ্দের জন্য প্রতীক সংখ্যা ৬৯ থেকে বাড়িয়ে ১১৫টি করলেও সেখানে শাপলা রাখেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সাংবাদিকদের জানান, অতীতেও কোনও কোনও দল শাপলা প্রতীক চেয়েছিল, কিন্তু দেওয়া হয়নি। কমিশনার বলেন, জাতীয় প্রতীক ও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার্থে আইন আছে। তবে জাতীয় ফুল বা ফলের বিষয়ে আইন করা হয়নি। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে শাপলাকে নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে তফসিলভুক্ত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতীক তালিকা চ‚ড়ান্ত করার পরে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। কেননা ওই তালিকায় শাপলা নেই। কমিশন সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, এনসিপি নিবন্ধন পেলেও, তালিকায় না থাকায় তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পাবে না। নির্ধারিত তালিকা থেকেই প্রতীক নিতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী রাজনৈতিক দলকে নির্ধারিত তালিকার ভেতর থেকেই প্রতীক নিতে হয়। কিন্তু এনসিপি শাপলা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে অনড়। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ২২ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, শাপলার দাবি তারা ছাড়বেন না। হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘যদি এ প্রতীক দেওয়া না হয়, সেটা কীভাবে নিতে হয়, তা আমরা জানি।’
এ দুদিন পরে শাপলা, সাদা শাপলা অথবা লাল শাপলাকে নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে যেকোনও একটি বরাদ্দের আবেদন জানায় এনসিপি। অর্থাৎ এনসিপিকে শাপলা দিতে হলে নির্বাচন কমিশনকে প্রতীকের তালিকা সংশোধন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুন ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেয় এনসিপি। তখন তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল প্রতীক চেয়েছিল। কিন্তু ৩ আগস্ট ইসি সচিব বরাবর আরেক আবেদনে এনসিপির আহŸায়ক নাহিদ ইসলাম পছন্দের প্রতীকে সংশোধনী এনে শাপলা, সাদা শাপলা অথবা লাল শাপলা চান।
সবশেষ এনসিপির পক্ষ থেকে ইসি সচিবের ই-মেইলে পাঠানো আবেদনে বলা হয়েছে, ‘শাপলাকে প্রতীক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার ক্ষেত্রে ইসির সিদ্ধান্ত কোনও আইনি ভিত্তি দ্বারা গঠিত নয়, বরং এনসিপির প্রতি বিরূপ মনোভাব ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। ইসির এমন একরোখা কার্যকলাপে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ও সব দলের ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরির ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।’
কিন্তু বিদ্যমান তালিকার বাইরে গিয়ে এনসিপিকে শাপলা দেওয়া সম্ভব নয় বলে ইসি সচিবের বক্তব্যের পরে ফেসবুক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম লিখেছেন, ‘যেহেতু কোনও আইনগত বাধা নেই, তাই এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে। অন্য কোনও অপশন নাই। না হলে নির্বাচন কীভাবে হয়, আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নেব।’
শাপলা প্রতীক না পেলে রাজপথে নামারও হুঁশিয়ারি দেন সারজিস। ২৪ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা ও উপজেলার এনসিপি কমিটির সমন্বয় সভা শেষে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের সব নিয়ম মেনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি এবং প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ নির্বাচন কমিশন বলছে, শাপলা তাদের তালিকাভুক্ত প্রতীক নয়। অথচ শাপলা যেমন একটি প্রতীকের অংশ হতে পারে, তেমনি তালিকাভুক্ত অন্যান্য প্রতীকের অংশ ধানের শীষও। যদি অন্য দলগুলো প্রতীকের অংশ হিসেবে এগুলো পেতে পারে, তাহলে এনসিপিকেও শাপলা প্রতীক দিতে হবে। আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে আমরা রাজপথে নামতে বাধ্য হবো।’
অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত এক বছরে ৬টি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে এবি পার্টি (ঈগল), গণঅধিকার পরিষদ (ট্রাক), নাগরিক ঐক্য (কেটলি), গণসংহতি আন্দোলন (মাথাল), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ফুলকপি) এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি (রকেট)। কিন্তু এর কোনও দলের প্রতীক নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়নি বা কোনও দল কোনও একটি নির্দিষ্ট প্রতীকের ব্যাপারে অনড় থাকেনি।
যেমন এই সময়ের বাংলাদেশে ‘মাথাল’ খুব পরিচিত প্রতীক নয়। কিন্তু গণসংহতি আন্দোলন বলেনি যে তারা এই প্রতীক নেবে না। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি বলেনি যে তারা ফুলকপি নয়, বাঁধাকপি চায়। গণঅধিকার পরিষদ বলেনি যে ট্রাক তাদের পছন্দ নয়। তাহলে এনসিপি কেন শাপলা প্রতীকের ব্যাপারে আপসহীন? অনেকের মনে এই প্রশ্নও আছে যে, এনসিপি কি বিশেষ কোনও দল যে তাদের পছন্দের প্রতীক দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের তালিকা সংশোধন করতে হবে? এটা কি তাদের ইগো যে, তারা প্রত্যাশিত প্রতীক না পেলে মানুষ মনে করবে যে নির্বাচন কমিশন তাদের পাত্তা দিচ্ছে না অথবা তাদের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রতীকের তালিকা সংশোধন করলে তারা অনেক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য হবে?
নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার জন্য তারা নীতিমালা পরিবর্তন করবে, সেই এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের আছে। কিন্তু যদি তারা এটা না করে, তাহলে কী হবে? এনসিপি কি এখন পর্যন্ত এমন কোনও বড় বা শক্তিশালী দল হয়ে উঠতে পেরেছে যে তাদেরকে পছন্দের প্রতীক দিতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করতে পারবে? তাছাড়া একটি প্রতীকের জন্য এই জোরজবরদস্তির প্রয়োজনই বা কতটুকু? এটা কি নিতান্তই নিজেদেরকে অন্য দলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রমাণ করার চেষ্টা? যদি এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়া না হয়, তাহলে কি দল হিসেবে তাদের গুরুত্ব কমে যাবে বা শাপলা পেলে মানুষ তাদের বেশি ভোট দেবে আর শাপলা না পেলে কম ভোট পাবে?
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনপ্রত্যাশী বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ ‘গমের শীষ’ প্রতীক চেয়েছিল। বিএনপি তখন এর বিরোধিতা করে বলেছিল, গমের শীষ আর ধানের শীষ দেখতে একইরকম। সুতরাং ধানের শীষের ভোটাররা ভুল করে গমের শীষে ভোট দিতে পারেন। আবার উল্টোও হতে পারে। এরকম বাস্তবতায় বিএনএফ গমের শীষের বদলে ‘ধান গাছ’ প্রতীকের জন্য আবেদন জানায়। যদিও ‘গমের শীষ’ বা ‘ধান গাছ’ কোনোটাই না দিয়ে বিএনএফকে প্রতীক দেওয়া হয় টেলিভিশন।
পরিশেষে, গোলাপ ফুল প্রতীক হিসেবে খুবই সুন্দর। শান্ত। সৌম্য। ¯িœগ্ধ। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে এই প্রতীকের দল জাকের পার্টি কয়টা ভোট পায়? মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দেশের মানুষের সবচেয়ে পছন্দের প্রতীক ছিল নৌকা। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেই এখন বিপন্ন। সংকটাপন্ন। হয়তো আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নিতেই পারবে না। সুতরাং তাদের নৌকা প্রতীক থাকলেই কি আর না থাকলেই কী? প্রতীক হচ্ছে দলের একটা পরিচিতি। এটাই সবকিছু নয়। একটি দলের প্রতীক কী, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই দলের কর্মসূচি এবং দলের নেতৃত্বে থাকা লোকজনকে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা কতটা গ্রহণ করছে।
লেখক : সাংবাদিক