
ইতিহাস বড়ই নির্মম, নিষ্ঠুর। ইতিহাসে লেখা আছে বহু বীরত্বগাঁথা, বহু কাহিনী। এদেশের ইতিহাসেও তাই এমন অনেক মানুষের কথা লেখা আছে যাদেরকে আমরা স্মরণ করি কালেভদ্রে। ইতিহাস বিখ্যাত এমনই একজন নারী হচ্ছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে এই নামটি জড়িয়ে আছে ওৎপ্রোতভাবে। চট্টগ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম এই মহিয়সী নারীর।
তারিখটি ছিল ১৯১১ সালের ৫ মে। সময়টা ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। সেদিনের অনেক বিপ্লবীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাস্টার দা সূর্য সেন। মাস্টার দা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এই বীরকন্যা। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে প্রথম আত্মোৎসর্গকারী নারী হচ্ছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশরা শোষণ-নিপীড়ন করে বাঙালিদেরকে যারপরনাই অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। দিকে দিকে তাই রব ওঠেছিল এদেশ থেকে ব্রিটিশ খেদাও।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শৈশবের পড়াশোনা শুরু করেন চট্টগ্রাম থেকেই। চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। কৃতিত্বটা হচ্ছেন তখনকার ঢাকা বোর্ডে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ দর্শন শাস্ত্রে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে প্রীতিলতা দৈনিক পত্র-পত্রিকা ও প্রচুর বই পড়তেন। বিশেষ করে স্বদেশী লেখা বইগুলো তাঁকে প্রচুর টানতো। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন। দেশের মানুষের উপর অত্যাচার-নির্যাতন তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
এ দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি-শিক্ষানীতি সবই নিয়ন্ত্রণ করতো একচেটিয়া ব্রিটিশরা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাস্টার দা সূর্য সেন, দিপালী নাগ, লীলা নাগের মতো দেশপ্রেমি বাঙালিরা সেদিন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বেথুন কলেজে পড়াশোনার সময়ই স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেদিনকার সময়ে ‘দিপালী সংঘ’ নামে একটি সংগঠনের বেশ কার্যক্রম ছিল। এই সংগঠনের মাধ্যমে স্বদেশীদের সংঘবদ্ধ করা হতো। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, লীলা নাগ এমনই দেশপ্রেমী নারীরা এই সংঘের অধীনে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
‘দিপালী সংঘ’-এর মতো আরও একটি সংঘ ছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন কল্যাণী দাস। সংগঠনের নাম ছিল ‘ছাত্রী সংঘ’। এমন নানা প্রকার সংগঠনের সাথে প্রীতিলতা জড়িয়ে স্বদেশী আন্দোলন করতেন। তাঁর মনে তখন গেঁথে গিয়েছিল এদেশের উপর অন্য কারো খবরদারি করা চলবে না। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলে তাদেরকে স্বদেশী সম্পর্কে বোঝাতেন। নিজেও কঠোর পরিশ্রম করতেন।
জানাযায়, কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর চট্টগ্রাম নন্দনকাননে অপর্ণাচরণ নামে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে কিছুকাল প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মন বসছিল না। তাঁর মনে পড়ে থাকতো স্বদেশী চিন্তায়। ১৯৩০ সাল উত্তাল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র তিনি পাঠ করে সব তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং কর্মীদের নিয়ে সেসব তথ্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের প্রথম নারী সদস্য ছিলেন প্রীতিলতা। এ সময় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। যেমন সরকারি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস, রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখল এবং জালালাবাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে কলকাতার আলীগড় কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত রাজবন্দী রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি। ১৯৩২ সালের জুন মাসে ধলঘাট যুদ্ধে কয়েকজন বিপ্লবী প্রাণ হারালে প্রীতিলতা ও মাস্টার দা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যান। সেদিন থেকে পুলিশের জরুরি তালিকাভুক্ত হন প্রীতিলতা। সে সময় প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তসহ আরও অনেকে আত্মগোপনে চলে যান।
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন বিপ্লবীরা। এ আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্রীতিলতা। ক্লাবটির এমন দুর্নাম ছিল যে, সেখানে লেখা থাকতো- ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। ওই ক্লাবে সফল অভিযান শেষে একটি গুলি লাগে প্রীতিলতার গায়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়ার আশঙ্কায় মারাত্মক বিষ পটাশিয়াম সায়ানায়েড পানে আত্মাহুতি দেন এই বীরকন্যা। তবু শত্রুর হাতে ধরা দেননি। দেশ তাদেরকে মনে রেখেছে আজও। তাঁদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।