সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের আর্থিক সহায়তা

সড়ক দুর্ঘটনায় আবেদন ও অর্থ সহায়তার বিষয়ে জানে না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার

আপলোড সময় : ২৪-০৯-২০২৫ ০১:১৫:০৬ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২৪-০৯-২০২৫ ০৮:১৯:৩৪ পূর্বাহ্ন
শামস শামীম::
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার প্রতিনিয়ত কান্না বয়ে বেড়ায়। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অকাল প্রয়াণ ও স্বজন হারানোর গভীর ক্ষতের সঙ্গে ভেঙে পড়ে পরিবারের আর্থিক শৃঙ্খলাও। এ কারণে দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করে। এই অবস্থায় সরকার নিহতের পরিবারকে নির্দিষ্ট নিয়মে আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ৫ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
সহায়তা পাচ্ছেন দুর্ঘটনায় আহত ক্ষতিগ্রস্তরাও। তবে দুর্ঘটনার মাত্র ১ মাসের মাথায় আবেদনের বাধ্যবাধকতা থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শোক কাটিয়ে ওঠে আবেদন করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রচারণার অভাবে অনেকে এই ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সম্পর্কেও জানেন না। ভুক্তভোগীরা আবেদনের সময়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার অনুরোধ করেছেন। ট্রাস্টিবোর্ডের বিধি অনুযায়ী মৃত্যুর ১ মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সার্কেলে ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২ ফরম নং ৩২’ পূরণ করে ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্র দুই মাসের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের সরকারি নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সুনামগঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের ন্যায় সুনামগঞ্জে ২০২৪ সাল থেকে দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সম্প্রতি আর্থিক সহায়তা পেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২১ জন ও গুরুতর আহত ১ জন আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। দুর্ঘটনায় নিহত ২১টি পরিবার ৫ লক্ষ টাকা করে এবং আহত ১ জন ১ লক্ষ টাকা সহায়তা পেয়েছেন। বাকি ১০টি ফাইলের যাচাই-বাছাই চলছে। এছাড়াও দুটি ফাইল আইনি জটিলতার কারণে ঢাকা অফিসে অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গত ১৪ আগস্ট সুনামগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সহায়তার প্রথম চেক হস্তান্তর করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০২২ কার্যকর হওয়ার পর এই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ট্রাস্টি বোর্ডের অনুকূলে দুর্ঘটনা কবলিত পরিবারের বৈধ অভিভাবকরা আবেদনের সুযোগ পান। এ জন্য সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২ ফরম নং ৩২ এর মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদন করতে হয়। সহায়তার জন্য পরিবারের আইনগত অভিভাবককে মৃত্যুর ১ মাসের মধ্যেই স্ব স্ব সার্কেলে মৃত্যু সনদ, মামলা বা জিডি’র কাগজ, ওয়ারিশান সনদ দিয়ে আবেদন করতে হয়। দুর্ঘটনায় হতাহত পরিবারের আবেদনটি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করে। জেলা প্রশাসক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে যথাযথভাবে আবেদনটি পাঠিয়ে দেন। পরে সেখান থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বৈধ প্রতিনিধির নামে চেক ইস্যু হয়। জানা গেছে, আবেদন করার ১০ দিনের মধ্যে প্রবেশন কমিটি গঠিত হয়। ৩০ দিনের মধ্যে ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। আরো ৩০ দিনের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
ট্রাস্টি বোর্ডের বিধি অনুযায়ী দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনের ১ জন করে সদস্য এবং বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে কেবল চেয়ারম্যান বরাবরে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করা যেতো। ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের এক অফিস আদেশে ট্রাস্টি বোর্ডের নবম সভার সিদ্ধান্তে বিআরটিএ’র সকল জেলা ও মেট্রো সার্কেল অফিসে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে নিজ নিজ জেলা থেকে আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে মাত্র ১ মাসের মাথায় আবেদন করা হয় বলে শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলো যথাসময়ে আবেদন করতে পারছেনা। তাছাড়া সরকারের এই মহৎ উদ্যোগটি সম্পর্কে প্রচারণা না থাকায় অনেকেই জানতে পারছেনা।
সুনামগঞ্জ বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধশত নিহত হয়েছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিহত হয়েছেন আরো ৫৫ জন। গত বছর থেকে ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদন শুরু হলেও প্রচারণার অভাব এবং আবেদনের সময়সীমা কম থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেক পরিবারও আবেদন করতে পারেননি। তাই তারা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের নীলপুরে বাসের সংঘর্ষে সিএনজি যাত্রী রাজিয়া খাতুন নিহত হন। তার ছেলে আলী রাজ বলেন, রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলে সরকার টেকা দেয় ইতা আমরা জানিনা। কেউ কুনুদিন কইছেনা। আমরা গরিব মানুষ। পাইলে ভালা অইতো।

একই বছরের ১৮ নভেম্বর জামালগঞ্জে মোটরসাইকেল ও অটোরিকসার সংঘর্ষে মারা যান আলীপুর গ্রামের শুকুর আলী ও বাগানী গ্রামের সুলেমান মিয়া। তাদের স্বজনরা জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে সরকার সহায়তা দেয় তারা জানেন না।
নিহত সোলেমান মিয়ার ভাই মো. জাকারিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ভাই দিনমজুরি করে তার ছোট তিন সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণ করতেন। তার মৃত্যুর পর পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই পরিবার সরকারি সহায়তা পেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আমরা কেউ এ বিষয়ে কিছু জানিনা।
এদিকে দুর্ঘটনায় নিহতদের আইনী অভিভাবকরা জানান, তারা আবেদন করার পর সহায়তা পেয়েছেন। দুঃসময়ে এই সহায়তা তাদের কাজে দিয়েছে।
তবে আবেদনের সময়সীমা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। গত বছর ২৬ আগস্ট রাউলি সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান ট্রাফিক সার্জেন্ট সুবীর তালুকদার। তার মা লাবণ্য তালুকদার ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
তার ছোট ভাই সৈকত তালুকদার বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমরা এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। আমাদেরকে সারাজীবনই কান্না বয়ে বেড়াতে হবে। তবে সরকারের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ৫ লক্ষ টাকার সহায়তা প্রাপ্তির আবেদনের সময় বাড়ানো উচিত। শোকাহত পরিবার শোক সইতে সইতেই অনেক দিন চলে যায়। এই মেয়াদ অন্তত ২ মাস করা উচিত।
গত বছরের ১৮ এপ্রিল বাস ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান জনপ্রিয় লোকশিল্পী পাগল হাসানসহ তিনজন। তার সঙ্গে মারা যান ছাতকের শিমুলতলা গ্রামের আব্দুস সাত্তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাকে হারিয়ে পরিবার অকূল সাগরে ভাসছে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তার স্ত্রী সাফিয়া বেগম ৫ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তার মেয়ে রুবিনা বলেন, বাবার মৃত্যুতে আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমরা মানসিক সাহস হারিয়ে ফেলছি। সরকার ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ৫ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। এজন্য তড়িঘড়ি করে আবেদন করতে হয়েছে। আবেদনের মেয়াদ অন্তত ৩ মাস করা উচিত বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্রাস্টি বোর্ডের কার্যক্রম শুরুর পর আমরা সম্প্রতি ২২ জন ক্ষতিগ্রস্তকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। আরো ১০-১২টি আবেদন প্রসেসিংয়ে আছে। দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে জেলা বিআরটিএ অফিসে যথাযথ কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করলে ক্ষতিপূরণ সম্ভব।

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com