শস্যবীমা : কৃষক ও অর্থনীতির নিরাপত্তা

আপলোড সময় : ১২-০৯-২০২৫ ০৯:৩৭:০৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ১২-০৯-২০২৫ ০৯:৩৭:৫০ পূর্বাহ্ন
রাধেশ্যাম সরকার::
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি ও পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে কৃষকরা প্রতিনিয়ত ফসল উৎপাদনে ঝুঁকির মুখে পড়েন। এই ঝুঁকি শুধু কৃষকের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তা সরাসরি দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে। বহুবার দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কৃষকরা তাদের মৌসুমি ফসল হারান এবং অনেক সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। জীবিকা অনিশ্চিত হওয়ায় নতুন ফসল রোপণ ও কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের আগ্রহও কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে আর্থিক সুরক্ষা দিতে এবং খাদ্য উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে শস্যবীমা (ক্রপ ইন্স্যুরেন্স) হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। শস্যবীমার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিঝুঁকি মোকাবিলায় এটি কার্যকরভাবে চালু রয়েছে এবং কৃষক, অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন কৃষি বিভাগ-এর অধীনে ‘ফেডারেল ক্রপ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম’ পরিচালিত হয়, যা সরকারি ভর্তুকি এবং বেসরকারি কো¤পানির মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়। এই ব্যবস্থায় কৃষকরা খরা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় বা বাজারমূল্য পতনের জন্য ক্ষতিপূরণ পান, ফলে তাদের আয় অনেকটা স্থিতিশীল থাকে এবং বিনিয়োগ ও চাষাবাদে ঝুঁকি নিতে তারা সাহসী হন। চীনের সরকারও কৃষকদের শস্যবীমার জন্য উল্লেখযোগ্য ভর্তুকি প্রদান করে, বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বীমা অত্যন্ত জনপ্রিয়। জাপানে ‘ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের’ অধীনে বাধ্যতামূলক শস্যবীমা ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় কৃষকরা নিয়মিত ক্ষতিপূরণ পান। কানাডায় প্রডাকশন ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম সরকার ও প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে পরিচালনা করে, যা শস্য উৎপাদনের ঝুঁকি কমায় এবং কৃষক সহজে ব্যাংক ঋণ পেতে পারেন। ভারতে ‘চৎধফযধহ গধহঃৎর ঋধংধষ ইরসধ ণড়লধহধ (চগঋইণ)’ নামে জাতীয় শস্যবীমা কর্মসূচি সারাদেশে কার্যকরভাবে চলছে। এ ছাড়া আফ্রিকার কিছু দেশে যেমন কেনিয়া, ইথিওপিয়া, ঘানা ইত্যাদিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএফএডি, এফএও এবং বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় আবহাওয়াভিত্তিক শস্যবীমা চালু হয়েছে, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, শস্যবীমা কেবল কৃষকের আয় স্থিতিশীল রাখে না, বরং কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করলে দেখা যায়, দেশের কৃষিক্ষেত্রে শস্যবীমা কার্যকরভাবে এখনও চালু হয়নি, যদিও ফসল উৎপাদনের ওপর বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কৃষকের আর্থিক ক্ষতির সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শস্যবীমা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন প্রায় নিয়মিত ফসল উৎপাদনে ক্ষতি করে। এই পরিস্থিতিতে শস্যবীমার মাধ্যমে কৃষককে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা হলে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। শস্যবীমা কৃষককে কেবল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে না, বরং তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ সহজ করে এবং নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের ফসলের প্রতি বিনিয়োগে উৎসাহ জাগায়। ফলে এটি কৃষিকে আরও টেকসই, লাভজনক এবং ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর করে তোলে। বাংলাদেশে শস্যবীমা কার্যকরভাবে চালু করতে গেলে কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সচেতনতার অভাব একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। দেশের অধিকাংশ কৃষক শস্যবীমার কার্যকারিতা, উপকারিতা এবং ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া স¤পর্কে যথেষ্ট অবগত নয়। গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এই ধরনের বীমার ধারণা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। প্রিমিয়াম প্রদানের অসুবিধা রয়েছে। অনেক কৃষকের আয় সীমিত হওয়ায় প্রিমিয়াম পরিশোধ করা তাদের জন্য কষ্টকর, বিশেষ করে প্রান্তিক বা ঋণগ্রস্ত কৃষকরা এই খরচ বহন করতে পারছে না। প্রশাসনিক জটিলতা বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয়। ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, অতিরিক্ত কাগজপত্র এবং কখনও কখনও দুর্নীতির কারণে কৃষকরা বীমায় আস্থা হারাতে পারেন। ক্ষতি নিরূপণের জটিলতা বিদ্যমান; ফসল নষ্টের প্রকৃত পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন, বিশেষ করে বড় ফসলের ক্ষেত্রে বা দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে। শস্যবীমা কার্যক্রম এখনও সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে এবং এটি দেশের সব কৃষি অঞ্চলে বিস্তার পায়নি, যার ফলে সম্ভাব্য কৃষকের অনেকেই এর সুফল ভোগ করতে পারছেন না। এসব সীমাবদ্ধতা সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব। শস্যবীমার সম্ভাবনা বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রসারিত। ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ইমেজ, ড্রোন এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতি নিরূপণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান অনেক সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে ফসলের আচ্ছাদন ও উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করা যায়, যা দ্রুত ও সঠিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে। আবহাওয়া সূচকভিত্তিক বীমা চালু করলে খরা বা অতিবৃষ্টির ডেটা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান সম্ভব হবে, যা প্রান্তিক কৃষকের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে শস্যবীমা কার্যক্রম টেকসই এবং বিস্তৃত করা সম্ভব। স্থানীয় কৃষি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। ক্ষতিপূরণ দ্রুত দেওয়ার জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যাতে কৃষক সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে শস্যবীমার মডেল তৈরি ও মূল্যায়নে সম্পৃক্ত করা যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই এবং কার্যকর শস্যবীমা নীতির জন্য অপরিহার্য। শস্যবীমার সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালু কেবল কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে না, বরং এটি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি কৃষকের আয় স্থিতিশীল রাখে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজারমূল্য পতনের সময়, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। শস্যবীমার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ সহজ হয়, কারণ কৃষক ঝুঁকি কম হওয়ায় বিনিয়োগে উৎসাহী হয়। এটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ সহজ করে, ফলে কৃষক নতুন ফসলের জন্য পর্যাপ্ত মূলধন পায়। শস্যবীমা গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে এবং দরিদ্রতা হ্রাসে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, শস্যবীমা কার্যকরভাবে পরিচালিত হলে কৃষকের আয় স্থিতিশীল হয়, খাদ্য উৎপাদন সুরক্ষিত থাকে এবং কৃষি খাত টেকসই হয়। বাংলাদেশেও সঠিক নীতি, আইন, সরকারি ভর্তুকি এবং প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করলে এ ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপকার অর্জন সম্ভব। সময় এসেছে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও টেকসই শস্যবীমা ব্যবস্থা গড়ে তোলার। শস্যবীমা কৃষককে আর্থিক নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করে, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজারমূল্য পতনের সময়ও তাদের জীবনধারা স্থিতিশীল থাকে। এটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কারণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া কৃষক নতুন ফসল রোপণে আগ্রহী হয় এবং উৎপাদন কমে না। সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ব্যবহার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব শস্যবীমাকে কার্যকর ও টেকসই করতে পারে। এ ছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট, আবহাওয়া সূচকভিত্তিক ক্ষতিপূরণ এবং গবেষণাভিত্তিক উদ্যোগ শস্যবীমার কার্যকারিতা বাড়ায়। ফলে এটি শুধু কৃষকের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজের জন্যও এক শক্তিশালী সহায়ক হিসেবে কাজ করে, যা বাংলাদেশের কৃষি খাতকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে সক্ষম।
রাধেশ্যাম সরকার : কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com