
সুখেন্দু সেন:
বনজ, খনিজ, প্রাণীজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে, সৌন্দর্যে ভরপুর কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য আলবার্টার রাজধানী এডমন্টন হলেও ক্যালগেরি এ রাজ্যের বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। কেবল আলবার্টা রাজ্যটিই বাংলাদেশ থেকে পাঁচগুণ বড়। মন্ট্রিয়ল থেকে বিমানে ক্যালগেরি পৌঁছতে সময় লেগেছে পাঁচ ঘণ্টা।
‘বো’ এবং ‘এল-বো’ নদী দু’টির সংগম স্থলে এবং রকি পর্বতমালার পাদদেশে এ শহরটি অবস্থিত। তেল, গ্যাস ও ব্যাংকিং খাত ক্যালগেরিকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। ক্রমেই শহরের অবকাঠামোগত চাকচিক্য বেড়ে যাচ্ছে। ক্যালগেরিতে বাঙালি ইমিগ্রেন্টদের অধিকাংশই ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষিত শ্রেণির লোক। বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের শীর্ষ দশটির মধ্যে ক্যালগেরির অবস্থান।
টানা ক’বছর অবস্থান ছিল পাঁচে। ১৯৮৮ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজক ছিলো এ শহর। ক্যালগেরিকে নীলাকাশের শহরও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ শহরটি গ্রীষ্মে মেঘমুক্ত ও রৌদ্রজ্জ্বল থাকে। বৃষ্টিপাত কম হয়, তবে এবার আমরা এখানে এসে বেশ ক’দিন বৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে গেছি যা সচরাচর হয় না। আমাদের হোস্ট ডা. দেবজ্যোতি দাম বললেন, আমরা নাকি সুনামগঞ্জের বৃষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
তিন সপ্তাহের জন্য আমাদের অবস্থান ক্যালগেরিতে। এদেশে গ্রীষ্মকালটাই সুন্দর, উপভোগ্য ও আনন্দের। এ সময়ের জন্য সারা বছরের অপেক্ষা থাকে, মনছুট তাগিদ থাকে, গায়ে রোদমেখে বেড়িয়ে পড়ার টান থাকে। প্রকৃতি যেনো হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় দূরে আরো দূরে। দিগন্ত ছোঁয়ার ছাড়পত্র এসময়েই যেনো পৌঁছে যায় হাতে হাতে। তবে বড় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গ্রীষ্ম আসে। তাই স্বল্প সময়েই যে যেভাবে পারে উপভোগ করে নেয় এই গ্রীষ্মটাকে। এর মাঝে যদি বৃষ্টি এসে বাগড়া দেয় তাহলে মন খারাপ হবারই কথা। তবে বৃষ্টির একটি স্বস্তির দিকও রয়েছে। দাবানল কম হয়।
সেই মনছুট বেড়িয়ে পড়া দলে আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল দু’মাস আগে, দেশে থাকতেই। সে অনুযায়ী হোটেল বুকিংসহ সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন হোস্ট। এ ছাড়াও তৈরি ছিল আরো অনেক ভ্রমণ সিডিউল।
আবহাওয়া বার্তায় জানা গেলো ক্যালগেরিতে সমান্য বৃষ্টি থাকলেও আমাদের প্রথম গন্তব্য আড়াইশো কিলোমিটার দূরে বিউভিয়াস লেকে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। দুদিনের এ ভ্রমণ সূচিতে আরো আছে ছোট শহর পিনছার ক্রিক - এর রামাদা হোটেলে রাত্রিবাস, পরদিন আমেরিকা সীমান্তের কাছাকাছি ওয়াটারটন পার্ক, রেড রক মাউন্টেন, ব্লাকিস্টোন ফলস।
সকাল দশটার দিকে দশ বারোটা গাড়ি নিয়ে এখানকার স্বজন, বন্ধুজন মিলে ৪৯ জনের দলটির যাত্রা। তবে একসঙ্গে একই স্থান থেকে রওয়ানা দেয়া গেলো না। ক্যালগেরি বিস্তৃত একটি শহর। উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে হলে প্রান্তর, বন, পাহাড় পেরোতে হয়। এক জায়গায় মিলিত হতে হলে অতিরিক্ত আধ ঘণ্টার ড্রাইভ, তাই সময় বাঁচানোর জন্য যারযার সুবিধা মতো রাস্তা ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে মিলিত হওয়া।
অজ¯্র পথ আছে পাহাড় ঘিরে। সবগুলিই ঝকঝকে তকতকে। একটি গাড়িতে আমরা চারজন, ছুটছি ২২ এক্স হাইওয়ে ধরে। পাহাড়ের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ। সে হাইওয়ে থেকে শতশত এক্সিট, এ পথ সে পথ কোথায় যে মিলিয়ে গেছে কে জানে। ভাবছি এই বন পাহাড়ে এত এত রাস্তাঘাট তৈরি করে রেখেছে কার জন্য। মানুষজন তো কোথাও চোখে পড়ে না। তবে বনের পশুরা যাতে এপাশ থেকে ওপাশে যেতে গাড়িচাপা না পড়ে সে জন্য কোথাও কোথাও রাস্তার ওপর দিয়ে এ্যনিমেল সেফ এক্সিট রয়েছে।
জনবিরল প্রান্তর, দিগন্তবিস্তৃত ঢেউ দোলানো তৃণভূমি যেনো সবুজ নরম মখমল বিছানো। মনে হয় - পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে। ভুট্টা, আলু, গম, শস্যক্ষেত্র আবার কখনও ঘন বন। পাথুরে পাহাড়ে সবুজের কী মায়া জড়ানো চারপাশে, যে দিকে তাকাই যেনো প্রকৃতির আপন আলয়। বিধাতার নিজ হাতে তৈরি এক-একটি ল্যান্ডস্কেপ। মনে হয় নেমে পড়ি। নরম সবুজে গড়াগড়ি যাই। কিছু বন্য ঘ্রাণ গায়ে মাখি। কিন্তু তা হবার নয়। হাইওয়েতে মন চাইলেই গাড়ি থামানো যায় না।
প্রকৃতির খাঁজে খাঁজে যে লেখাজোখা তা কেবল চোখ দিয়েই দেখা নয় - হৃদয়েরও অবশ্য পাঠ্য। তবে ভাবতে খারাপ লাগে, আগস্ট পেরোলেই শীতের প্রকোপ শুরু হয়ে যাবে, সবুজ পাতারা ঝরে পড়তে শুরু করবে, ঘাসগুলি ধূসর হয়ে যাবে। ফসলের মাঠ একসময় বরফের আচ্ছাদনে ঢেকে যাবে। বৃক্ষরা পত্রপুষ্পহীন বিবর্ণ হয়ে পড়বে। ক্রিসমাস গাছের ডালে ডালে তুলার মত পেজা পেজা তুষার জমে থাকবে। ক্ষণস্থায়ী গ্রীষ্ম বলেই হয়তো প্রকৃতি সারা বছরের মোহনীয়তা, রূপে-রঙে এত মোহময়তা, এত পেলবতা একই সঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছে।
পথে যেতে পাওয়া গেলো ক্যাননক্সিক ভিলেজ। এই গ্রামে দূরে পাহাড়ের কোলে জনবিরল স্থানে একটি বিলাসবহুল হোটেলে এবছরের ১৫ থেকে ১৭ জুন হয়ে গেছে জি-৭ সামিট। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি, জাপান, কানাডা অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মিলিত হয়েছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
বিউভাইস লেক ন্যাশনাল পার্কটি হলো পাহাড়ের উপরে বনভূমি বেষ্টিত একটি শান্ত জলের হ্রদ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে বনপথে ঘুরে বেড়ানো, পাহাড়ে চড়া, সাইকেল রাইড, লেকে মাছ ধরারও ব্যবস্থা রয়েছে। রাস্তার পাশে অনেক জায়গায় সতর্কীকরণ নোটিশ “ভাল্লুক হতে সাবধান” কিছুটা ভয়েরও কারণ। শৌখিন ভ্রমণ পিয়াসিরা লেকের পাড়ে তাঁবু টেনে রাত্রিযাপনও করে। আবার বিলাসী পর্যটকেরা রিক্রিয়েশনেল ভেহিকলে কয়েকদিন কাটিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে খাবার ও রান্নার সরঞ্জাম ছিলো। দুপুরে রান্নাবানা করে লেকের পাড়ে খাওয়া-দাওয়া হলো। চা, কফি, হালকা খাবারও ছিলো। কেউ কেউ বড়শী ফেলে ব্যর্থ হলেন।
শীতে যখন বরফ জমবে তখন বনভূমির অন্য আরেক রূপ। স্কেটাররা স্কেটিং করতে এখানে এসে ভিড় জমায়। সন্ধ্যার আগেই লেক পর্ব শেষ করে আমরা ফিরে গেলাম বারো কিলোমিটার দূরে ছোট শহর পিনছার ক্রিকে। শহরের অধিবাসীর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মত। প্রায় দেড়শত বছর আগে মাউটেন্ড পুলিশের ঘাঁটি থেকে এ শহরের উৎপত্তি হয়। এখানকার একটি বিশ্বমানের হোটেল ‘রামদা’-তে আমদের ডিনার, গল্পগুজব, গান, আড্ডা, নানা রকম বিনোদন ও রাত্রিবাস। এ হোটেলে সাধারণত পর্যটকেরাই অবস্থান করে এবং বিভিন্ন দিকে ঘুরতে যায়। সকাল বেলার হোটেলে ব্র্যাকফাস্ট, আপনা হাত জগন্নাথ। সবই ইংলিশ, আমেরিকান খাবার। এগুলো ঠিক জুতমত খাওয়া যায় না। তবে কানাডার ঐতিহ্যবাহী ম্যাপল সিরাপ ফ্রাইকেকে মিশিয়ে খেতে মন্দ লাগেনি।
এবারের যাত্রা ওয়াটারটন লেক ন্যাশনাল পার্ক। আমেরিকা সীমান্তের কাছাকাছি এক ভূস্বর্গ। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। ক্যালগেরি বা আলবার্টা এসে ওয়াটারটন না দেখলে সবই নাকি বৃথা। নিচে বিস্তৃত লেক এবং পাহাড়ের ওপরে শতবর্ষী প্রিন্স অব ওয়েলস হোটেল। হলিউডের অন্যতম সুটিং স্পট। অনেক সিনেমাতেই এই হোটেলটির দেখা মিলে। এমনকি বলিউডের ছবিতেও দেখা যায়। ১৯৩২ সালে কানাডা অংশের ওয়াটারটন লেক পার্ক এবং আমেরিকা অংশের গ্লেসিয়ার পার্ক মিলে এর নামকরণ হয় ওয়াটারটন- গ্লেসিয়ার আন্তর্জাতিক পিস পার্ক। মোটর বোটে চড়ে ১৫ মিনিট কানাডার অংশ এবং ১৫ মিনিট আামেরিকার অংশে ঘুড়ে বেড়ানো যায়।
সেখান থেকে আরো কয়েক কিলোমিটার দূরে রেডরক মাউন্টেন। লাল পাথরের পাহাড়। সেখানেও পর্যটকদের ভীড়। বেশ কষ্ট করে গাড়ি পার্কিং পাওয়া গেলো। পাহাড়ের চূড়ায় তখনও বরফ জমে আছে। সেই বরফ গলা ঠা-া জল লালপাথরের খাত বেয়ে নেমে আসছে। সেই ঝিরঝির জল ধারার পাশেই আমাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন। এখানে বন্য হরিণেরা নির্ভয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়। তবে এদেরকে কোনো খাবার দিতে নিষেধ করা আছে। দাবানল দগ্ধতায় সৌন্দর্য কিছুটা ম্লান হলেও লাল পাথরের পাহাড়টিতে বেশ ভালো সময়ই কাটলো। রেড রক থেকে দেড় কিলোমিটার পাহাড়ি বনপথ পেরিয়ে ব্লাকিস্টোন ঝরণা। সে বনপথেও ভাল্লুক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়লো। আমাদের সঙ্গীরা সে পথ বর্জন করলেও আমরা আট-দশ জন কেবল শেষ অব্দি ঝরণার কাছাকাছি গিয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে অতুলনীয় প্রকৃতির ছোঁয়ায় সে ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আকাশের রঙ তখন বদলে গেছে। আসন্ন সন্ধ্যার পটভূমিতে সিঁদুরে মেঘ ধীরে ধীরে কালোতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। আমাদের ফেরার পালা। বৃষ্টি নেমে গেছে। সঙ্গে হালকা শিলাপাত। নীলাকাশের শহর ক্যালগেরি তখন শ্রাবণের কৃষ্ণ মেঘে ঢাকা পড়ে আছে।