
বি এম মইনুল হোসেন::
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলাধীন ১০টি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। ৪৬টি গ্রাম, ৫১টি জলমহালসহ পুরো হাওর এলাকার মোট আয়তন ২৮ বর্গকিলোমিটার। তবে নলখাগড়া বন, হিজল-করচ বনসহ বর্ষাকালে পুরো হাওরের আয়তন দাঁড়ায় ১০০ বর্গকিলোমিটারে বেশি। এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ১২০টি বিল। শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে স্থানীয় ভাষায় কান্দা নামে পরিচিত বিলের পাড়গুলো জেগে ওঠে। তখন শুধু কান্দার ভেতরের অংশেই আদি বিল থাকে, বাকি অংশে হয় চাষাবাদ। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামে পরিচিত। মাদার অব ফিশারিজ, সব হাওরের মা, ইত্যাদি নামে খ্যাত এ হাওরকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সুন্দরবন, বাকি আরেকটি হাকালুকি হাওর। রামসার স্থান হলো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি, বিশেষ করে যেগুলো জলপাখির আবাসস্থল প্রদান করে, যেটি রামসার কনভেনশন অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দাবি করে। এ সংখ্যা, তথ্য আর আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যে সত্য ফুটে ওঠে না, তা হলো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। জৈন্তা আর খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে, মেঘ-পাহাড়ের লীলাভূমি এ টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের স্বচ্ছ জলরাশি, হিজল-করচের গাছ, ডিঙিনৌকায় ভাসতে থাকে সহজ জীবন আর সরল জীবিকা। কাছাকাছি অবস্থানে আরও আছে যাদুকাটা নদী। ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে তাহিরপুর উপজেলা দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালু, পাথর ও স্বচ্ছ সবুজ পানি অন্য রকম আকর্ষণ তৈরি করে মনোজগতে। হাউসবোটগুলোর ছাদে বসেই দেখা যায় নদীপারের দুর্লভ দৃশ্য, বিস্তীর্ণ চরাচরে ঘুরে বেড়ানো গবাদিপশুর দল, নদীতীরে ভেসে বেড়ানো গৃহস্থবাড়ির হাঁসের দল। দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা সাঁতার কেটে চলে আসে জলযানের একেবারে কাছে, গালভরা হাসি দিয়ে অভিবাদন জানায় পর্যটকদের। ওদিকে বিশাল আকাশ কালো করে মেঘ আসে, খানিক পর বৃষ্টির জল হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় হাওরের অতিথিদের। তবে বাংলাদেশের এক প্রান্তে সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি যে অযতেœ পড়ে আছে, সেটি দেখলে দুঃখই হবে। প্রাথমিক পর্যটন সুবিধাটুকুও নেই অনন্য অসাধারণ জায়গাগুলোতে, নেই পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ। নি¤œমানের মহাসড়ক দিয়ে সারা রাত গাড়িতে হেলেদুলে সুরমার তীরের শহরে উপস্থিত হয়ে জড়ো হয়ে থাকা হাউসবোটের কোনো একটা ঘাটে পৌঁছে সামান্যতম সুবিধাযুক্ত একটি গণশৌচাগার পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। পরিবার-পরিজনসহ কেউ একবার গেলেও দ্বিতীয়বার যেতে তৃতীয়বার ভাবতে হয়। ফেরার পথে ঘাটে নৌযানগুলো ফিরে আসার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে শহরে ফিরে আসার জন্য সহজে পাওয়া যাবে না কোনো যানবাহন। নিরাপত্তার জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এ সুবিশাল জলধারায় দুর্ঘটনা এড়াতে চোখে পড়ে না কোনো নিরাপত্তা টহল ও প্রাথমিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা। অথচ পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় স্থান হতে পারত এসব জায়গা। এ রকম সৌন্দর্যময় স্থান বাংলাদেশের অন্য আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ আছে। শুধু যাদুকাটা নদীর অববাহিকায়, পরিবেশের ক্ষতি না করেও সুযোগ আছে পর্যটনশিল্পের বিশাল বিনিয়োগের। সঠিক ব্র্যান্ডিং করা গেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের বৃষ্টি দেখার জন্য টানা সম্ভব দেশি-বিদেশি পর্যটক। হাউসবোটকেন্দ্রিক যে পর্যটন এখন প্রচলিত আছে, সেটি নিয়েও আছে নানা কথা। এ নদী অববাহিকা কিংবা হাওরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা। প্রতিনিয়ত হাউসবোটের হর্ন, শব্দ, পানিদূষণ, বর্জ্য নিঃসরণের যে উৎপাত আছে, সেটি নীতিমালার মধ্যে আনার প্রয়োজন তো আছেই, সঙ্গে এ পর্যটনে স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। অতিথিরা এল-গেল, স্থানীয় লোকজনের স্বাভাবিক জীবনে ব্যত্যয় ঘটাল, কিন্তু হাওরবাসীর যে দুঃখ, সে দুঃখই থেকে গেল, তাহলে তো সেটি টেকসই কোনো ফল বয়ে আনবে না; বরং ভবিষ্যতে বাড়িয়ে তুলবে অসন্তোষ। নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পর্যটন করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিবেশের ক্ষতি না করে এটিকে অপার সম্ভাবনার একটি জায়গায় রূপান্তর করা যায়। সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওর ‘সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ অভিভাবকহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। আদালত আরও বলেছেন, এ হাওরকে ‘সবাই মিলে যেমন ইচ্ছা তেমন ধ্বংস করছে।’ সরকারি নির্দেশনা মেনে টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট চলাচল করে কি না, হাওরে কতগুলো হাউসবোট আছে, হাউসবোটের মালিকের নাম-ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, বোট কোন ঘাটে অবস্থান করে, কোন রুট দিয়ে যাতায়াত করে তাসহ হাউসবোটগুলো যথাযথভাবে নিবন্ধিত কি না, সে অনুযায়ী চলে কি না, এগুলো সরকারি কর পরিশোধ করে কি না, তা বিস্তারিত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত। সত্যিকার অর্থেই এ নির্দেশনাগুলো মেনে চললে, প্রথম প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হলেও ভবিষ্যতের সবাই লাভবান হবেন।
[ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক]
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলাধীন ১০টি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। ৪৬টি গ্রাম, ৫১টি জলমহালসহ পুরো হাওর এলাকার মোট আয়তন ২৮ বর্গকিলোমিটার। তবে নলখাগড়া বন, হিজল-করচ বনসহ বর্ষাকালে পুরো হাওরের আয়তন দাঁড়ায় ১০০ বর্গকিলোমিটারে বেশি। এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ১২০টি বিল। শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে স্থানীয় ভাষায় কান্দা নামে পরিচিত বিলের পাড়গুলো জেগে ওঠে। তখন শুধু কান্দার ভেতরের অংশেই আদি বিল থাকে, বাকি অংশে হয় চাষাবাদ। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামে পরিচিত। মাদার অব ফিশারিজ, সব হাওরের মা, ইত্যাদি নামে খ্যাত এ হাওরকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সুন্দরবন, বাকি আরেকটি হাকালুকি হাওর। রামসার স্থান হলো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি, বিশেষ করে যেগুলো জলপাখির আবাসস্থল প্রদান করে, যেটি রামসার কনভেনশন অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দাবি করে। এ সংখ্যা, তথ্য আর আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যে সত্য ফুটে ওঠে না, তা হলো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। জৈন্তা আর খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে, মেঘ-পাহাড়ের লীলাভূমি এ টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের স্বচ্ছ জলরাশি, হিজল-করচের গাছ, ডিঙিনৌকায় ভাসতে থাকে সহজ জীবন আর সরল জীবিকা। কাছাকাছি অবস্থানে আরও আছে যাদুকাটা নদী। ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে তাহিরপুর উপজেলা দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালু, পাথর ও স্বচ্ছ সবুজ পানি অন্য রকম আকর্ষণ তৈরি করে মনোজগতে। হাউসবোটগুলোর ছাদে বসেই দেখা যায় নদীপারের দুর্লভ দৃশ্য, বিস্তীর্ণ চরাচরে ঘুরে বেড়ানো গবাদিপশুর দল, নদীতীরে ভেসে বেড়ানো গৃহস্থবাড়ির হাঁসের দল। দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা সাঁতার কেটে চলে আসে জলযানের একেবারে কাছে, গালভরা হাসি দিয়ে অভিবাদন জানায় পর্যটকদের। ওদিকে বিশাল আকাশ কালো করে মেঘ আসে, খানিক পর বৃষ্টির জল হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় হাওরের অতিথিদের। তবে বাংলাদেশের এক প্রান্তে সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি যে অযতেœ পড়ে আছে, সেটি দেখলে দুঃখই হবে। প্রাথমিক পর্যটন সুবিধাটুকুও নেই অনন্য অসাধারণ জায়গাগুলোতে, নেই পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ। নি¤œমানের মহাসড়ক দিয়ে সারা রাত গাড়িতে হেলেদুলে সুরমার তীরের শহরে উপস্থিত হয়ে জড়ো হয়ে থাকা হাউসবোটের কোনো একটা ঘাটে পৌঁছে সামান্যতম সুবিধাযুক্ত একটি গণশৌচাগার পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। পরিবার-পরিজনসহ কেউ একবার গেলেও দ্বিতীয়বার যেতে তৃতীয়বার ভাবতে হয়। ফেরার পথে ঘাটে নৌযানগুলো ফিরে আসার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে শহরে ফিরে আসার জন্য সহজে পাওয়া যাবে না কোনো যানবাহন। নিরাপত্তার জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এ সুবিশাল জলধারায় দুর্ঘটনা এড়াতে চোখে পড়ে না কোনো নিরাপত্তা টহল ও প্রাথমিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা। অথচ পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় স্থান হতে পারত এসব জায়গা। এ রকম সৌন্দর্যময় স্থান বাংলাদেশের অন্য আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ আছে। শুধু যাদুকাটা নদীর অববাহিকায়, পরিবেশের ক্ষতি না করেও সুযোগ আছে পর্যটনশিল্পের বিশাল বিনিয়োগের। সঠিক ব্র্যান্ডিং করা গেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের বৃষ্টি দেখার জন্য টানা সম্ভব দেশি-বিদেশি পর্যটক। হাউসবোটকেন্দ্রিক যে পর্যটন এখন প্রচলিত আছে, সেটি নিয়েও আছে নানা কথা। এ নদী অববাহিকা কিংবা হাওরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা। প্রতিনিয়ত হাউসবোটের হর্ন, শব্দ, পানিদূষণ, বর্জ্য নিঃসরণের যে উৎপাত আছে, সেটি নীতিমালার মধ্যে আনার প্রয়োজন তো আছেই, সঙ্গে এ পর্যটনে স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। অতিথিরা এল-গেল, স্থানীয় লোকজনের স্বাভাবিক জীবনে ব্যত্যয় ঘটাল, কিন্তু হাওরবাসীর যে দুঃখ, সে দুঃখই থেকে গেল, তাহলে তো সেটি টেকসই কোনো ফল বয়ে আনবে না; বরং ভবিষ্যতে বাড়িয়ে তুলবে অসন্তোষ। নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পর্যটন করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিবেশের ক্ষতি না করে এটিকে অপার সম্ভাবনার একটি জায়গায় রূপান্তর করা যায়। সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওর ‘সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ অভিভাবকহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। আদালত আরও বলেছেন, এ হাওরকে ‘সবাই মিলে যেমন ইচ্ছা তেমন ধ্বংস করছে।’ সরকারি নির্দেশনা মেনে টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট চলাচল করে কি না, হাওরে কতগুলো হাউসবোট আছে, হাউসবোটের মালিকের নাম-ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, বোট কোন ঘাটে অবস্থান করে, কোন রুট দিয়ে যাতায়াত করে তাসহ হাউসবোটগুলো যথাযথভাবে নিবন্ধিত কি না, সে অনুযায়ী চলে কি না, এগুলো সরকারি কর পরিশোধ করে কি না, তা বিস্তারিত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত। সত্যিকার অর্থেই এ নির্দেশনাগুলো মেনে চললে, প্রথম প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হলেও ভবিষ্যতের সবাই লাভবান হবেন।
[ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক]