
মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী::
বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা একটি সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে সংসদ গঠন করে। এ সংসদ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে এবং রাষ্ট্রপতির ভূমিকা থাকে প্রতীকী। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের শাসন ব্যবস্থা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আজকের অবস্থানে এসেছে। কখনো একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা, কখনো সামরিক শাসন অথবা কখনো নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের আড়ালে রচিত হয়েছে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদ। আর এসব নানান বাধার সম্মুখীন হয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পায়নি বিকশিত হওয়ার মতো আদর্শ পরিবেশ।
আবার যতটুকু সময় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মুক্ত চর্চা করা গেছে সে সময়টুকুও জর্জরিত ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সহিংসতাসহ নানান অপরাজনৈতিক অসংগতিতে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এসব অপরাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এসব কারণেই গণতান্ত্রিক আবহাওয়া থাকলেও জনমানসে গণতন্ত্রের মূল চেতনা হয়েছে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ফলস্বরূপ সাধারণ্যের থেকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতা দিন দিন শুধু বেড়েছে। তৈরি হয়েছে গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। কিন্তু এ বিরূপ প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারুণ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যখনই গণতন্ত্র তথা জনগণের শাসন ব্যাহত হয়েছে, তখনই এ দেশের শিক্ষার্থী তথা তরুণ সমাজ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। যার ব্যত্যয় ঘটেনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের অবসানে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটেও। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণতন্ত্রকামী জনতার সম্মিলিত প্রয়াসেই পালাতে বাধ্য হয়েছে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা। বিলোপ ঘটেছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অপশাসনের।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৮-৩৫-এর মধ্যে। এ তরুণ প্রজন্ম একদিকে যেমন প্রযুক্তি-সচেতন, শিক্ষিত ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিস¤পন্ন, অন্যদিকে তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক শক্তিই এক্ষেত্রে একমত যে তারুণ্যই জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে এবং এ প্রজন্ম যদি রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় গঠনমূলকভাবে যুক্ত হয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তবে দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরও বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটি অংশ রাজনীতি থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, নেতিবাচক প্রচারণা, আদর্শের অভাব এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে তরুণ নেতৃত্বের কথায় ও কাজে পরিপক্বতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি অনেক তরুণকেই হতাশ করেছে। তারা পরিবর্তনের আশাবাদ নিয়ে রাজনীতিতে এলেও বাস্তবিক চাপে সেই আদর্শ আকাক্সক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন বলেই একটা ধারণা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মনে গেঁথে গেছে।
সমস্যার এ জটিলতার মাঝেও আশার আলো রয়েছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার তরুণদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুনভাবে সংযুক্ত করছে। তারা এখন দেশ ও বিশ্বের রাজনীতির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে পারে, মতামত গঠন করতে পারে এবং জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানের বৃহৎ প্রেক্ষাপট বাদেও ক্ষুদ্রতর প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা এখন সংগঠিত হতে শিখেছে, পরিবর্তনের জন্য সোচ্চার হতে শিখেছে।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নেতৃত্বের ঈষৎ হতাশাজনক ভূমিকার পরও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বাংলাদেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক শক্তির কাছে এটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে বাংলাদেশের রাজনীতি যদি তরুণদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়, যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে তরুণরা আরো সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসবে, সঙ্গে নিয়ে আসবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অভাবনীয় নতুন উদ্যম ও উন্নতি। আগামীর দিনে যারাই গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের মনে রাখতে হবে যে সঠিক শিক্ষা, সচেতনতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নের মাধ্যমে একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব, যারা শুধু ক্ষমতার রাজনীতিতে নয়, বরং ন্যায়, সুশাসন ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখবে।
অতএব এটি বলাই বাহুল্য যে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতির উন্নয়নে তরুণদের অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজনীয় নয়, এটি অবশ্যম্ভাবী। ভবিষ্যতের একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে তারুণ্যের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো জরুরি। কারণ সময়ে সময়ে তরুণ প্রজন্মই পারবে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
[মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী : দপ্তর স¤পাদক (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদা), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]