আকরাম উদ্দিন
সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী সৈয়দুর রহমান ভাই ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। তিনি যেমন সুন্দর ছিলেন, তেমন সুন্দর ছিল তাঁর মন। তিনি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে থাকতে ভালবাসতেন। আলোকিত মানুষ গড়ার বিষয়ে ছিল তাঁর ভাবনা। এ বিষয়ে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার চিন্তাও করতেন তিনি। গরীব-দুখিকে ভালবাসতেন। বিপদ-আপদে মানুষ সৈয়দুর ভইয়ের পরামর্শ পেয়ে শান্তি পেতো। নিজের স্বজনদেরও জীবনমানের উন্নয়নে সহযোগিতা করতেন।
প্রবাস থেকে ফিরে এসে সেই ১৯৯০ সালে আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনের আলাপচারিতায় বলেছিলেন আমি সমাজের জন্য কাজ করতে চাই। আমি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলতে চাই। চাই সামাজিক শৃংখলা, চাই কর্ম এবং গ্রামে প্রতিষ্ঠিত পরিকল্পিত স্বাবলম্বী পরিবার গড়ে উঠুক। সবাই মিলেমিশে আমরা সমাজ উন্নয়নে কাজ করবো। এমন অনেক কথা বলেছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় সৈয়দুর ভাই।
আমার অবুঝ বেলায় তিনি গিয়েছিলেন প্রবাসে। এই প্রবাস জীবনে কেটেছিল তাঁর দীর্ঘদিন। আমার বাড়ির পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন সৈয়দুর ভাই। স¤পর্কে আমার চাচাতো ভাই। ওই সময় থেকে আমার ও আমার আপন চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলমের সাথে একান্ত বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল সৈয়দুর ভাইয়ের। এক কথায় অবসরে ভাল সময় কাটাতে যাওয়া হতো সৈয়দুর ভাইয়ের কাছে। তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে দারুণ মানিয়ে কথা বলতে পারতেন। কোনো কোনো সময় দু’জনের চলাফেরায় মৌখিক গল্প তৈরি করতাম। যার উদ্দেশ্যে তৈরি করতাম, আবার তার সামনে পরিবেশন করে আনন্দ উপভোগ করতাম।
অবসর সময়ে শহরে হেঁটে হেঁটে বেড়ানো ছিল আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস। ধর্ম-কর্ম বা যেকোনো আলোচনায় সৈয়দুর ভাইয়ের সাথে ছিল আমার বেশ মিল। ১৯৯১ সাল থেকে সামাজিক ও মাসজিদিক কাজে আমি, সৈয়দুর ভাই ও নবী হোসেন পরশ ভাই যুক্ত ছিলাম।
২০০১ সালে একটি সংগঠনের কাজে দুই জন ঢাকায় গিয়ে কয়েক দিন থেকে বেশ আনন্দ করেছিলাম। ২০০৫ সালে শিক্ষায় এগিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সিএফএসডি’র বই তোলে দিতাম। শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষার অগ্রগতিতে এলাকায় সভা করতাম। ওই সময় আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথমআলো’র খলিল ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকায় সম্মেলনে গিয়েছিলাম। ২০১৪ সালে সুনামকণ্ঠ’র স¤পাদক বিজন দা’র আহ্বানে খেলাঘর সংগঠনের মাধ্যমে এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে জেলা শিল্পকলায় অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলাম। শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাগ্রে। তিনি টিআইবি’র সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
এক সময় আমরা গ্রামে নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস পালনে নানা আয়োজন করতাম। গরীব মানুষদের নানা সমস্যায় শারীরিক ও আর্থিক সহযোগিতা করতাম। এসব সামাজিক কাজে মতামত ব্যক্ত করতেন আমাদের আরেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আলহাজ নবী হোসেন পরশ। তাদের অনুপ্রেরণায় আমি ২০১৪ সালে মসজিদ পরিচালনা কমিটির গঠনতন্ত্র রচনা করতে পেরেছি। এই গঠনতন্ত্রে দেশে অনেক সুনাম কুড়িয়েছি। তাদের অনেক পরামর্শ পেয়েছি। এসব কাজে উৎসাহ দেওয়ায় আমি আলহাজ্ব নবী হোসেন পরশ ভাই, প্রয়াত আলহাজ্ব সৈয়দুর রহমান ভাই এবং জসিম উদ্দিন ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রবাস জীবন থেকে ফিরে এসে যে স¤পর্ক স্থাপন হয়েছিল দু’জনের, এই সুবাদে সৈয়দুর ভাই বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে ফাইনাল শেয়ার করতেন আমার সাথে। আমিও সকল বিষয়ে শেয়ার করতাম ভাইয়ের সাথে। যাক, বিদেশ থেকে আসার পর থেকে এতোটি বছর খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল সৈয়দুর ভাইয়ের সাথে। একজন স¤পূর্ণ ভাল মানুষের সাথে স¤পর্ক ভাল রাখাও ভাল।
এক সময় শহরে বসতি স্থানান্তর হওয়ায় কিঞ্চিৎ যোগাযোগ শূন্যতা পড়লেও তা পুষিয়ে নিতাম শহরের টেলিকম ওয়ার্ল্ডে বসে। কিন্তু সদ্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও বন্যার রিপোর্টিংয়ের নানা ঝামেলায় পড়ে গত প্রায় দেড় মাস খোঁজ-খবর রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি তাঁর ছেলে শাহরিয়ারের বিয়েতে যাওয়াও সম্ভব হয়নি আমার।
গত বৃহ¯পতিবার রাতে যখন খবর পেয়েছি সৈয়দুর ভাই খুব অসুস্থ। মনে করেছিলাম সকালে গিয়ে বাসায় দেখা করব। সকালে বাসায় গেলেও ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। এর আগে ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দুর ভাই। তিনি আমাদের মতো মানুষের জন্য শহরে বটবৃক্ষ ছিলেন। শান্তির নিঃশ্বাস ছিলেন তিনি। দেখা হলেই ভাল লাগতো।
শুক্রবার ভোরে চলে গেলেন এই নক্ষত্র। আমার জীবনে যাদের সান্নিধ্য পেয়েছি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আকমল হোসেন ভাই, অ্যাড. আলী হোসেন ভাই, আব্দুল আলী ভাই। এঁদের আমি সান্নিধ্য পাওয়া আমাদের আলোকিত মানুষ। এসব নক্ষত্র হারিয়েছি আমরা। আজ তারা কবরের বাসিন্দা।
শ্রদ্ধেয় সৈয়দুর ভাইয়ের মরদেহের নামাজে জানাজা শেষে রাখা হলো পরকালের দ্বিতীয় ধাপ কবরে। আজ থেকে কবরের বাসিন্দা প্রিয় ভাই, সৈয়দুর ভাই। আল্লাহ তুমি সৈয়দুর ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।