
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশও করেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে গত রবিবার একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা চ্যালেঞ্জিং হলে নির্বাচন সম্ভব। ৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে শুরু থেকেই নির্বাচনের কথা বলে আসছে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসা দলটি লন্ডন বৈঠকের পর ‘ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল’ ভোটের ব্যাপারে আশাবাদী। ফলে সিইসির ‘সম্ভব’ এর সঙ্গে বিএনপির সুর অভিন্ন।
তবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনের ব্যাপারে নীতিগত একমত হলেও ‘সংস্কার’, ‘বিচার’, ‘জুলাই সনদ’, ‘আইনশৃঙ্খলা’, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ইত্যাদি তুলে ধরে ‘ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল’ নির্বাচন নিয়ে পরোক্ষ অনীহা প্রকাশ করে আসছে। অর্থাৎ সিইসির ‘সম্ভব’ নিয়ে দল দুটির সুর ভিন্ন।
নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই নানা ধরনের মন্তব্য করেছে জামায়াতে ইসলামী। তারা প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত ডিসেম্বর থেকে জুন সময়সীমাকে স্বাগত জানালেও পরে দলটি কখনো ফেব্রুয়ারি, কখনো এপ্রিল মাসের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে দলের নেতারা এসব মতভেদের ব্যাখ্যায় বলেন, এটি তারিখ নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন নয়, বরং নির্বাচনের প্রস্তুতির বাস্তবতা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ।
জামায়াতের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচন কার্যকর হবে না। তাদের অভিযোগ, সরকার নির্বাচনপূর্ব সংস্কার বায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি একটি জনসভায় জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় বিএনপির এক কর্মী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনায় প্রমাণ হয়, এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না।’
জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) আরও কড়া ভাষায় বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য নির্বাচন আয়োজনের কোনো মানে হয় না, যদি দেশে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক পরিবর্তন না আসে। দলটির একাধিক নেতার মতে, নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে, তবে সেটা গঠনমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হতে হবে। এনসিপি বর্তমানে ঢাকার বাইরে পদযাত্রা কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যেখানে তারা এ দাবিগুলো বারবার তুলে ধরছে।
জামায়াত ও এনসিপি সরাসরি না বললেও তাদের বক্তব্যে বিএনপির অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে সংবিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ভারসাম্যসংক্রান্ত ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে ভিন্নমত রাখছে এ দুই দল।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে জামায়াত ও এনসিপি, যার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দল। তাদের মতে, এতে মাঠপর্যায়ে আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। যদিও এর ঘোরবিরোধী বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সময়সীমা ঘোষণা করা হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত নিয়ে ভিন্নমত এখনো স্পষ্ট। সব পক্ষই নির্বাচন চায়, তবে সেটি হতে হবে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং মৌলিক সংস্কারভিত্তিক। রাজনৈতিক ঐকমত্য ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি না হলে আগামীর নির্বাচন অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, বিভিন্ন ইস্যু কেন্দ্র করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে লক্ষ্য করে ‘সংঘবদ্ধভাবে চাপে ফেলার প্রবণতা’ স্পষ্ট বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে যেকোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটলেই তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হচ্ছে কটাক্ষ, ট্রল এবং অশালীন ভাষার আক্রমণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রচারকে ‘পরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করছে বিএনপি।
দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে জনমানসে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি মহল সচেষ্ট। দলটির অভিযোগ, সরকারের একটি অংশ এবং কিছু রাষ্ট্রীয় সংস্থা এসব অপপ্রচারে ইন্ধন দিচ্ছে, আবার দুষ্কৃতকারী চিহ্নিত হলেও তাদের গ্রেপ্তারে প্রশাসন নীরব ভূমিকা রাখছে। বিএনপির দাবি, দল সবসময় অন্যায় ও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান বজায় রেখেছে। তাই এসব ইস্যুর ফাঁদে তারা পা দেবে না।
দলীয় সূত্রমতে, উচ্ছৃঙ্খলতা ঠেকাতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি বহিষ্কার করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০০ নেতাকর্মীকে। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকেও শত শত নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, পদ স্থগিত ও শোকজ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একদিকে বিএনপি বড় রাজনৈতিক সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, সন্ত্রাসী বা অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। এদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব আছে। বিএনপি ইতিমধ্যেই বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিলেও, তা যথেষ্ট কি না সে প্রশ্ন এখন দলের ভেতরেও ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে দল ক্ষমতার সম্ভাবনায় থাকাকালে এ ধরনের সহিংসতা, দখলবাজি ও অপরাধ কর্মকা-কে কেউ কেউ দেখছেন ‘রাজনৈতিক আত্মঘাত’ হিসেবে।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও একাধিকবার সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি গত শনিবার ঢাকায় এক ভার্চুয়াল সভায় বলেন, আমরা দেখেছি, প্রকাশ্য ভিডিও ফুটেজে অপরাধ সংঘটন সত্ত্বেও এখনো দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাহলে কি সরকার এই ঘটনায় নীরব সমর্থন দিচ্ছে?
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের বক্তব্য, আচরণ ও সংগঠনবিরোধী কর্মকা- কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তারেক রহমান। তিনি অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসা এবং দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আপনি খেয়াল করেন, ঘটনা ঘটলে দেশে একটি সরকার আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, আইন-আদালত আছে। তাদের কাছে আপনি দাবি করেন। আপনি কী করছেন? বিএনপির বিরুদ্ধে কতিপয় লোক দিয়ে মিছিল করাচ্ছেন। আপনি কি চান যে আমরা পাল্টা মিছিল করি? এই উসকানি দিয়ে আমাদের উসকাচ্ছেন? বিএনপি কারও উসকানিতে পা দেবে না।
তিনি আরও বলেন, মব ভায়োলেন্স শুরু করেছে কারা? বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন তো স¤পৃক্ত নয়। খুঁজে দেখেন, আপনাদের পত্রিকার পাতাগুলো ওল্টান। তাহলেই মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে পেয়ে যাবেন, পরিচয় জেনে যাবেন। বিএনপি আইনের শাসনে বিশ্বাস করে, বিএনপি মব ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যারা অপরাধ করেছে, তাদের গ্রেপ্তার করতে প্রশাসন ব্যর্থ কেন? জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন অনেক খেলাই তারা খেলতে চাইবে। নির্বাচন পেছানোর জন্য যত ধরনের ষড়যন্ত্র প্রয়োজন সবই তারা করবে। কিন্তু বিএনপির পরিস্থিতি ধৈর্য ধরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে। শেখ হাসিনাকে যেমন প্রতিহত করেছি, নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রও প্রতিহত করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মিটফোর্ডের ঘটনায় আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনায় বিএনপির ওপর দায় চাপানো হচ্ছে, যা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।
নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন অভিযোগ এলেও নির্দিষ্ট সময়ে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হবে এমনটি জানিয়েছেন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টরা। গত রবিবার নির্বাচনের প্রস্তুতি স¤পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রস্তুতি আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চাই। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়ের বিষয়েও আলোচনা হওয়ার কথা বলেন তিনি।
আপনারা কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এমন প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, সম্পূর্ণ প্রস্তুত। যদি হয় আমাদের তরফ থেকে আমরা প্রস্তুত। আমরা ওভাবে করতে চাই, উনারা যে তারিখে পোলিং ডেট চান, যেদিন ভোট হয়, সেদিন যাতে আমরা একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন জাতিকে উপহার দিতে পারি, সে লক্ষ্যেই আমরা প্রস্তুতিটা নিচ্ছি।
গত শনিবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সভাকক্ষে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির বিকল্প নেই। নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। - দেশ রূপান্তর