
দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বড়কাটা গ্রামের বাস্তবতা আমাদের সুনামগঞ্জের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অবহেলিত যোগাযোগ সমস্যার প্রতিচ্ছবি। তিন হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস, দুটি মসজিদ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের প্রায় দশ হাজার মানুষের প্রতিদিনের চলাচলের একমাত্র ভরসা একটি বাঁশের সাঁকো। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য শুধু লজ্জাজনকই নয়, একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কাক্সিক্ষত ভারসাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, রোগী, শিশু, বৃদ্ধ - সবাইকে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। বর্ষায় এই সাঁকো ভয়াবহ রূপ নেয়। ভেঙে পড়া, ¯্রােতে ভেসে যাওয়া, পিচ্ছিল হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রতিনিয়ত থেকে যায়। এতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিত্য জীবনযাত্রা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ধীরগতির শিকার। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে আমরা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইছে বলে দাবি করি। সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও দোয়ারাবাজারের বড়কাটা ও তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষ এখনো সেতুর আশায় প্রহর গুনছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষায়- “নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি, পরে বিস্মৃতি।” এটা মনে রাখতে হবে, একটি সেতু শুধু দুটি পাড় নয়, দুইটি জীবন, দুইটি সুযোগ, দুইটি সম্ভাবনাকে যুক্ত করে। একটি সেতু মানে একটি শিশুর নিরাপদে স্কুলে যাওয়া, একজন রোগীর দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো, একজন কৃষকের পণ্যের সহজ বাজারজাতকরণ। একটি সেতু মানে একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশের দ্বার উন্মোচন। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করলেও বারবার বড়কাটা ও আশপাশের গ্রামগুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে কেন? স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা চাই- এই আশ্বাস আর যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রতারণা না হয়। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে বড়কাটা ও আশপাশের ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকোগুলোর পরিবর্তে টেকসই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বড়কাটাই নয়, সুনামগঞ্জ জেলার বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও যাতায়াতের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। একটি জাতি তখনই উন্নত বলে বিবেচিত হয়, যখন তার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা পায়। বড়কাটার সেতু শুধু একটি নির্মাণ প্রকল্প নয়, এটি স্থানীয় মানুষের শিক্ষা-চিকিৎসা-অর্থনীতির সংযোগরেখা। আজই যদি এর বাস্তবায়ন না হয়, তবে উন্নয়নের এই কল্পিত স্রোত শুধু শহরের ইট-কাঠেই সীমাবদ্ধ থাকবে, গ্রামের হাওর-পাড়ার জীবন ছুঁতে পারবে না। আমরা চাই- এই অবহেলার অবসান হোক। প্রতিশ্রুতির অবসান হোক। বড়কাটায় হোক একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন। একটি পাকা সেতু দিয়ে ভরসা ফিরে আসুক মানুষের জীবনে।