সুনামকণ্ঠ ডেস্ক :: পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বৃহ¯পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, তারা পদত্যাগের বিষয়ে মনস্থির করেছেন। রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তবে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে তারা পদত্যাগপত্রে সই করে সচিবের কাছে জমাও দিয়েছেন। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন এই কমিশন। তাদের পরিচালনায় ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। এছাড়া এই আড়াই বছরে দেড় সহ¯্রাধিক পদে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন, উপনির্বাচন করেছে তারা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো নির্বাচন কমিশনেরও পদত্যাগের দাবি ওঠে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহ¯পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে এমন ঘোষণা দিলেন তিনি। এসময় ‘বিদায়ী ব্রিফিং’ নামে একটি দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য পেশ করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি তিনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার বক্তব্যে বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। কোনও নির্বাচনই ‘বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না’ বলেও দাবি করেন তিনি। ‘সৌজন্য বিনিময়’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান নির্বাচন ভবনে তাদের নিজ দফতরে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পরপরই কোনও প্রটোকল ছাড়াই ব্যক্তিগত গাড়িতে করে নির্বাচন ভবন ত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এর কিছুক্ষণ পর রাশেদা সুলতানা, মোহাম্মদ আলমগীর ও আনিছুর রহমানও নির্বাচন ভবন ত্যাগ করেন। এসময় আনিসুর রহমানের গাড়ি লক্ষ্য করে বিক্ষুব্ধ জনতা জুতা ছুড়ে মারেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এছাড়া নির্বাচন ভবনের গেটেও কমিশনারদের গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা ছুড়তে দেখা গেছে। সিইসি তার বক্তব্যের শুরুতেই দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচনের কথা (১৯৭৩ সালের নির্বাচন) তুলে ধরে বলেন, সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সেসময় নিরাপদ প্রস্থানের (সেফ এক্সিট) বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধান মতো দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। সিইসি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি, পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি; মন্তব্য নি®প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধ দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনও সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না দাবি করে সিইসি বলেন, সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে - তাও সংবিধানে সু¯পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনও কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে, দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচন নি®পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালোটাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচন সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালটপেপার পাঠানো, কিছু উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একই দিনে, তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে পাঁচ-ছয়টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল, ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি, উইথিন হয়েছে... নট বিটুইন। তিনি আরও বলেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুবছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনও নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন উদাহরণ নেই। সরকার বারবার বলেছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত। সিইসি বলেন, কমিশনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের কর্মকালে আমরা গণমাধ্যম, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আবশ্যক সবার সহযোগিতা পেয়েছি। কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করছি। সিইসি বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার (হোমোজেনিটি) কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে, অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। অধিকন্তু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।