‘মব ভায়োলেন্সে’ ভয়-উদ্বেগ

আপলোড সময় : ০৬-০৭-২০২৫ ১২:১২:৪৬ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ০৬-০৭-২০২৫ ১২:১২:৪৬ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক :: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় এক বছর পরও দেশ জুড়ে গণপিটুনি, সংঘবদ্ধ হামলা, গোষ্ঠী সহিংসতার ঘটনা ঘটছে; যা নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক শান্ত সামাজিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমেই বেড়ে চলছে ‘মব ভায়োলেন্স’। হামলা-সহিংসতা ও গণপিটুনিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাও কমে যাচ্ছে। তাই মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই শুরু পর্যন্ত দেশে গণপিটুনির ঘটনায় অন্তত ৯৪ জন নিহত হয়েছে। আসক মনে করে, এ ধরনের সহিংসতা বিচারহীনতার কারণে বাড়ছে এবং সমাজে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে প্রকাশ্যে মা ও দুই সন্তানকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনির সহিংসতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে উদ্বেগ বাড়ছে। মুরাদনগরে রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তার ছেলে রাসেল মিয়া (২৮) এবং মেয়ে জোনাকি আক্তারকে (২২) তাদের বাড়ি থেকে রাস্তায় নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পরিবারের আরও একজন নারী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রকাশ্যে এমন হত্যাকা- দেশ জুড়ে ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনায় আসক উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এমন বর্বর হত্যাকান্ড শুধু আইনের শাসনের পরিপন্থী নয়, এটি নাগরিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে নিরপেক্ষ ও প্রমাণনির্ভর তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে আহত নারীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আসক আরও জানায়, গণপিটুনি বা ‘মব সন্ত্রাস’ প্রশাসনিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। সরকারের দায়িত্ব এখনই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে এ ধরনের সহিংসতা রোধ করা এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অন্যথায় এ সহিংসতার দায় রাষ্ট্রের ওপরই বর্তাবে এবং সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা প্রশ্রয় দেবে। চলমান এ সহিংসতা রুখতে রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর, কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। গত বুধবার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় হামলাকারীরা থানার ওসিসহ ৩০ জনকে আহত করে এবং ওসির কক্ষসহ চারটি কক্ষ ভাঙচুর ও সরকারি মালপত্র লুট করে। পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পাটগ্রাম থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, বালুমহালের ইজারাদারের লোকজন অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ের সময় আটক দুই ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়। এর জেরেই ইজারাদার, সাবেক বিএনপি নেতা চপল হোসেনের নেতৃত্বে থানায় হামলা চালিয়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে চপল হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৩২ জনের নামে এবং অজ্ঞাত আরও কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছে। পুলিশও রেহাই পাচ্ছে না মব ভায়োলেন্স থেকে। আসামি ছাড়িয়ে নিতে এবং নানা দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহনে হামলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৪৭৭টি মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ এবং মে মাসে ৬২টি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, মব বা গণপিটুনির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। যেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশের ওপরও হামলা চালানো হচ্ছে। পুলিশের কাজ হচ্ছে অপরাধ ঘটলে তার ব্যবস্থা নেওয়া। অপরাধীদের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নিলে হবে না। তাই জনগণকে সচেতন হতে হবে। হেফাজতে থানায় আসামির মৃত্যু বিষয়ে পুলিশকেও হতে হবে সতর্ক ও সংযত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ সংবিধান ও আইনি প্রক্রিয়া। বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যেকোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তির অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে তার বিচার করতে হবে। বিচার ছাড়া মব বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ। একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, অভিযোগের প্রমাণ ছাড়াই এভাবে সুরাহা করার প্রবণতা জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। গত সরকারের আমলেও এ ধরনের প্রচুর অপরাধ হয়েছে। চারদিকে অভিযোগের বন্যা। এ অভিযোগ বন্যার প্রতিফলন হলো মব ভায়োলেন্স। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে এর একটা সুরাহা করার জন্য লোকজন মাঠে নেমে যায় এবং ভুলে যায় যে তারা এ অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে নিজেরাই অপরাধী হয়ে উঠছেন এবং অপরাধমূলক কাজ করছেন। যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ডিএমপির সব থানায় এ বিষয়ে আবারও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে গত বৃহ¯পতিবার সেনা সদরে এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, কাউকে গ্রেপ্তারের পর থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর যদি কেউ জামিন পেয়ে যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর কিছু করার থাকে না। যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্স, গণপিটুনি, সহিংসতা সবকিছুই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতাকে জানান দেয় বলে মত ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে মব ভায়োলন্সে যেভাবে বেড়েছিল, সেখান থেকে এখনো যদি একই রকমভাবে চলতে থাকে, সেটা অবশ্যই হতাশাজনক। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কথা বললেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ সেভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই জাতীয় অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। ফলে সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। -দেশ রূপান্তর

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com