
দুলাল মিয়া::
সমাজের প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে সেইসব মানুষের উপর, যাঁরা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের জন্য কাজ করেন। শিক্ষা, মানবিকতা ও সমাজসেবার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ মানুষগণ যুগে যুগে সমাজে আলোকবর্তিকা হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। তেমনই একজন ছিলেন আব্দুল জব্বার। যিনি ‘ফিসারি অফিসার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন নিবেদিত শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী এবং মানবতাবাদী। তাঁর নিরলস পরিশ্রম এবং মানবিক মূল্যবোধ সমাজে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আব্দুল জব্বার অবিভক্ত বাংলায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোবারক আলী এবং মাতা লুৎফুন্নেছা বেগম। তাঁর পিতা অঢেল ভূসম্পত্তির অধিকারী একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। আব্দুল জব্বার তাঁর পূর্ব পুরুষদের সামাজিক জনহিতকর কাজ দেখে দেখেই বড় হয়েছেন। তিনি কলকাতার স্বনামধন্য রিপন কলেজ থেকে আইএসসি এবং ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষার প্রতি গভীর আকৃষ্ট ছিলেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও অধ্যবসায় ও সততার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা অর্জন করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা পরবর্তীতে সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সম্পর্কে মামা অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পরবর্তীতে যিনি চিফ জাস্টিস হয়েছিলেন এবং তাঁর খালাতো ভাই ড. মোদাচ্ছের হোসেন ডিএলও এর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় চিফ জাস্টিস আব্দুস সাত্তার-এর ঢাকার আরমানি টুলাস্থ বাসায় ওঠেন। এবং এর কিছুদিন পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ফিসারি ডিপার্টমেন্টে অফিসার হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে চাকরি জীবন শুরু করেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কোণাগ্রাম সাহেব বাড়ি নিবাসী বর্তমানে যা নজিরাবাদ ইউনিয়নের নজিরাবাদ গ্রাম নামে পরিচিত, ওই গ্রামের কৃতী সন্তান আসাম আইন পরিষদের এমএলএ ও তৎসমের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নজির উদ্দিনের কন্যা খালেদা সুলতানা আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জব্বার-খালেদা দম্পতির পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা। আব্দুল জব্বার বিশ্বাস করতেন- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-।’ এই বিশ্বাস থেকে তিনি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে নিজ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সবসময় চিন্তা-ভাবনা করতেন। এই চিন্তা থেকেই সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যাপক আহমদ আলীসহ এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন। এর ধারাবাহিকতায় এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তিনি ‘দ্বীনি মজলিস’ নামে একটি সংগঠন করে তোলেন। এই সংগঠনে শিক্ষক মাওলানা মো. শওকত আলী, শিক্ষক মু. আব্দুর রহিম, অধ্যাপক আহমদ আলী, আব্দুল জব্বার, আব্দুল গফুর চৌধুরী, ডা. রেজওয়ানুল হক, কনু মিয়া ও ওয়াজেদ আলীসহ আরও অনেক ব্যক্তিবর্গ সদস্য ছিলেন। সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে আলোচনা করে ষোলঘর পুরাতন জামে মসজিদে বাদেশ্বরের মাওলানা জিয়াউল ইসলামের মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দ্বীনি শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠায় এটি নিয়মিত মক্তব হিসেবে চলতে থাকে। মাওলানা জিয়াউল ইসলামের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয় আব্দুল জব্বারের বাসায়। পরবর্তীতে তিনি মসজিদেই থাকতেন। দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব আব্দুল জব্বার খুব গভীরভাবে অনুভব করেন। সেই অনুভবের জায়গা থেকেই তিনি এলাকার মুরুব্বীগণের সাথে আলোচনা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকার মুরুব্বী ও সর্বস্তরের মানুষ দ্বীনি ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে একজন কামেল আলিম ফুলতলীর মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেবকে দিয়ে মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পূর্বে দোয়া ও আলোচনা মাহফিলের সিদ্ধান্ত হলে শিক্ষক মাওলানা শওকত আলীকে ফুলতলী সাহেবকে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ফুলতলী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে সুনামগঞ্জে আনার ব্যবস্থা করেন। এরপর ফুলতলী সাহেবের উপস্থিতিতে সুনামগঞ্জ ষোলঘরস্থ পুরাতন জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দ্বীনি মজলিসের সকল সদস্য, এলাকার মুরুব্বিয়ান ও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ওই সময় ফুলতলী সাহেব আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে দ্বীনি মজলিসের আহ্বানে একটি আলোচনা সভা হয়। ওই সভায় অধ্যাপক আহমদ আলীকে সভাপতি, আব্দুল জব্বারকে সেক্রেটারি এবং আব্দুর রহিম, ডা. করম আলী, মফিজুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মনিম পীর, মাওলানা শওকত আলী, আব্দুল গফুর চৌধুরী , রফিক আহমদ, চাঁন মিয়া, তোতা মিয়া ও মফিজ আলী প্রমুখকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। ষোলঘর পুরাতন জামে মসজিদের দক্ষিণ পাশে খালি জায়গায় তৎকালীন সময়ে ষোলঘরের প্রবীণ ব্যক্তি সাবেক এমপি ও পৌর চেয়ারম্যান আবু হানিফা আহমদ অসুস্থ অবস্থায় আব্দুল জব্বারের অনুরোধে মাদ্রাসার কাঁচাঘরের বাঁশের খুঁটি স্থাপন করেন। ষোলঘরের সর্বস্তরের মানুষ মাদ্রাসার ঘর তৈরিতে স্বেচ্ছায় সাহায্য - সহযোগিতা করেছেন। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটি / গভর্নিং বডিতে সভাপতি/ সদস্য হিসেবে অ্যাড. আব্দুর রউফ, অ্যাড. আফতাব উদ্দিন, গাজী শাহ, অ্যাড. মঈন উদ্দিন, অ্যাড. শাহারুল ইসলাম, একেএম মোর্শেদ, সোনাহর আলীহসহ অনেক গুণী ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকে এখনো করছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সুপার মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন আব্দুল্লাহ ও বর্তমান অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলীনূরসহ সকল শিক্ষক-কর্মচারী দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসাটিকে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। যা আজ ‘দ্বীনি সিনিয়র ফাজিল মডেল মাদ্রাসা’ হিসেবে স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রথিতযশা শিক্ষানুরাগী আব্দুল জব্বার আমৃত্যু ওই মাদ্রাসার অবকাঠামোগত ও শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক খরচাদি সাধ্যমতো নিজ থেকেই করেছেন। শুধু প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলাই নয়; তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এলাকায় শিক্ষার হার চোখে পড়ার মতো বেড়ে যায়। সুনামগঞ্জ অনগ্রসর এলাকা। পূর্ব থেকেই এখানে শিক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। বিশেষত নারী শিক্ষা। আব্দুল জব্বার মনেপ্রাণে অনুভব করতেন, নারী শিক্ষা শুধু নারীর অধিকার নয়, এটি সমাজের অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। এই অনুভূতি নিয়েই তিনি পর্যবেক্ষণ করেন বিশাল জনগোষ্ঠীর সুনামগঞ্জে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত একটিমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা জেলায় নারী শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই তিনি আরেকটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তীব্র তাড়না অনুভব করে। নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের তাড়না থেকেই তিনি আরেকটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হকের সাথে আলোচনা করে সুনামগঞ্জে আরও একটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রয়োজনীয়তা যে আছে, তা বোঝাতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মহকুমা প্রশাসকের সম্মতিতে শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মহকুমা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাপক আলোচনান্তে সুনামগঞ্জে নারী শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শহরে ‘সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং তা বাস্তবায়নের জন্য মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হককে সভাপতি, আব্দুল জব্বারকে সেক্রেটারি এবং দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, অ্যাড. রফিকুল বারী চৌধুরী, অ্যাড. আব্দুস সামাদ, অ্যাড. খলিলুর রহমান, আব্দুস সালাম, ধূর্জটি কুমার বসু, অ্যাড. ফজলুল হক আছপিয়া, অ্যাড. চাঁন মিয়াসহ শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্য ও শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ ও সহায়তায় বালিকা বিদ্যালয়টির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিদ্যালয়ের মাটি ভরাট ও ভবন নির্মাণকাজ স¤পন্ন করতে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার নিরলসভাবে সময় ও শ্রম দিয়ে যান। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অনেক দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী শিক্ষার আলো দেখতে পায়। তিনি সবসময় বিদ্যালয়ে যেতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। শিক্ষার মানোন্নয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বই-খাতা বিতরণ করেন। শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সকলের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় ‘সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ আজ জেলার অন্যতম বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শিশুদের আধুনিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে শহরে একটি কিন্ডারগার্টেন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষানুরাগীগণ অনুভব করেন। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী শিক্ষানুরাগী আব্দুল জব্বারসহ শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে সুনামগঞ্জ শহরে ‘আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতন’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল জব্বার সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় কিন্ডারগার্টেনটির ভবন পুনঃনির্মাণ ও বর্ধিতকরণসহ যাবতীয় কাজ অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে স¤পন্ন করেন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা লগ্নে শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা -কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে সচিব হিসেবেও তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার অনুমোদন সুদূর চিটাগাং ডিজি অফিস থেকে দক্ষতার সাথে নিয়ে আসেন। তিনি আমৃত্যু ওই কিন্ডারগার্টেনের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি স্কুলটির জিম্মা ট্রাস্টি বোর্ডেরও একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। সুনামগঞ্জ শহরে একটি মাত্র খেলার মাঠ ছিল। যা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সুনামগঞ্জের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মাত্র মাঠ কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। তাই শহরের শিক্ষার্থী ও তরুণদের জন্য একটি খেলার মাঠ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “খেলাধুলা মানুষকে শৃঙ্খলা, ধৈর্য, সহনশীলতা ও দলগত কাজ শিক্ষা দেয়।” এই বিশ্বাস থেকেই তিনি স্কুল - কলেজ - মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও এলাকার তরুণদের খেলাধুলার জন্য একটি বিকল্প খেলার মাঠ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করে একটি সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। সভাটি হয় শহরের বাজার মসজিদে। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল নজির আহমদ-এর সভাপতিত্বে ও আব্দুল জব্বার-এর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হক এর সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়। আলাপ আলোচনান্তে মহকুমা প্রশাসক মাঠ নির্মাণের পক্ষে সায় দেন। সরকারি বিধি মোতাবেক মাঠের জায়গা রিকুইজিশন করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের আওতায় গম বরাদ্দ করে খেলার মাঠ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বহু বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কঠোর পরিশ্রম ও তদারকির মধ্যে দিয়ে আব্দুল জব্বার সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় মাঠ নির্মাণ কাজ স¤পন্ন করেন। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হক, সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুল জব্বার এবং সদস্য ডা. করম আলী, চাঁন মিয়া, অ্যাড. আফতাব উদ্দিন প্রমুখ। সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেজন্য তিনি চিন্তা করতেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামিক স্কলারদের নিয়ে কীভাবে তাফসীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায় সেজন্য গুণীজনদের সাথে পরামর্শ করতেন। আব্দুল জব্বার ইসলাম দরদী সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাহায্য সহযোগিতায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কয়েকবার আন্তর্জাতিক খ্যাতি স¤পন্ন বক্তা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সুনামগঞ্জ ইসলামি তাফসীর মাহফিলে আসেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সুনামগঞ্জে যে কয়বার এসেছেন আব্দুল জব্বার ফিসারি অফিসারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সরশিনার গদিনিশীল পীর মাওলানা আবু জাফর সালে আহমদ (মাসুম সাহেব) ১৯৭৮ সালে সুনামগঞ্জে এসে মূল্যবান তাফসীর পেশ করেন। ওই সময় তিনি আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। জামায়াতে ইসলামের তৎকালীন আমির মাওলানা আব্দুর রহিম সুনামগঞ্জে কর্মী সমাবেশে যোগদান করেন এবং আব্দুল জব্বারের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম হাফেজে হুজুর সুনামগঞ্জে এসে তাফসীর পেশ করেন। ওই সময় তিনি আব্দুল জব্বার এর বাসায় অবস্থান করে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামিক স্কলার ইস্ট লন্ডন মসজিদের খতিব ও লন্ডনস্থ দারুল উম্মা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ মাওলানা আবু সাঈদ এবং লন্ডনস্থ বার্মিংহাম দারুল উম্মা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি স¤পন্ন বক্তা হাফেজ মাওলানা লুৎফুর রহমান সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে ইসলামিক সমাবেশে যোগদান করে মূল্যবান বয়ান পেশ করেন। ওই সময় তিনিও আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আব্দুল জব্বার (ফিসারি অফিসার) সমাজের সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন সবসময়। তিনি সুন্দর সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৭৭ সালের কথা। আমবাড়ি গোপালপুর মাদ্রাসার নিকটবর্তী যোগীরগাঁও গ্রামে যাত্রাগান, মদ ও জুয়ার আসরের আয়োজন করা হয়। এতে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ আবেদনের মাধ্যমে তৎকালীন জেলা প্রশাসকে অবহিত করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য দোয়ারাবাজার থানাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু দোয়ারাবাজার থানা জেলা প্রশাসকের নির্দেশ পেয়ে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গোপালপুর মাদ্রাসার সহকারী মুহতামিম মাওলানা আবুল ফজল এলাকার মুসল্লিগণকে সাথে নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরে আব্দুল জব্বারের বাসায় যান। তাঁকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশ দেওয়া কাগজপত্র দেখান এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জন্য অনুরোধ করেন। তখন রাত সাড়ে ১১টা। আব্দুল জব্বার তৎক্ষণাৎ সকলকে নিয়ে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল ওয়াহাব সরকারের বাসায় গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিষয়টি অবগত করেন এবং অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল জব্বারের অনুরোধ উপেক্ষা না করে সুনামগঞ্জ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপের আয়োজনটি স¤পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন। এভাবে সমাজ সংস্কার ও উন্নয়নে আব্দুল জব্বার বহু নজির রেখে গেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা কিংবা খরা - যেখানেই মানুষ বিপদে পড়েছে, সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তিনি ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসা সহায়তা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অসংখ্য মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। তিনি মাদকবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সামাজিক সমস্যা, মানুষের দুর্দশা, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। সমাজ উন্নয়নে তাঁর আন্তরিকতা, সততা ও মানবিকতা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৫ সালে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহতের পর পটপরিবর্তনে দেশে আওয়ামী লীগ এমপিদের ধরপাকড় শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জে আব্দুজ জহুর এবং অ্যাডভোকেট আব্দুর রইছ এমপিকে গ্রেফতার করে সিলেট কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তৎকালীন সময়ে সরকার আদালতে উপস্থিত হয়ে রাজসাক্ষী দেওয়ার জন্য আব্দুল জব্বার ও সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নানকে তলব করে। আব্দুল জব্বার যথাসময়ে সিলেট জজ কোর্টে উপস্থিত হয়ে আব্দুজ জহুর এবং অ্যাডভোকেট আব্দুর রইছ এর ওপর উনার বক্তব্য-জবানবন্দী পেশ করে স্পষ্টভাবে আদালতে বলেন, “আব্দুজ জহুর এবং আব্দুর রইছ উনারা সুনামগঞ্জের জনগণের নেতা ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তাঁরা মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ও অভিযোগ কেউ তুলতে পারবে না। আদালত তাঁর বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদেরকে মুক্তি দেন।” আব্দুল জব্বার ছিলেন বিনয়ী, পরিশ্রমী ও নীতিবান ব্যক্তি। তিনি কখনও নিজের কাজের প্রচার চাননি; বরং নীরবে কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানুষের জন্য কাজ করাই জীবনের প্রকৃত সফলতা।” তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপন ও সৎ মনোভাব সকলের কাছে তাঁকে ভালোবাসার মানুষে পরিণত করে। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজের জন্য কাজ করে গেছেন। আব্দুল জব্বারের শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকা- আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আজকের সমাজে যখন স্বার্থপরতা ও অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট, তখন তাঁর মতো মানুষ আমাদের আশা ও প্রেরণার আলো দেখান। তাঁর কর্ম, আদর্শ ও অবদান আজও সমাজে জীবন্ত। আশা করবো, তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম সমাজের কল্যাণে এগিয়ে আসবে। আব্দুল জব্বারের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
[লেখক : প্রভাষক, জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজ, ছাতক, সুনামগঞ্জ]
সমাজের প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে সেইসব মানুষের উপর, যাঁরা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের জন্য কাজ করেন। শিক্ষা, মানবিকতা ও সমাজসেবার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ মানুষগণ যুগে যুগে সমাজে আলোকবর্তিকা হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। তেমনই একজন ছিলেন আব্দুল জব্বার। যিনি ‘ফিসারি অফিসার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন নিবেদিত শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী এবং মানবতাবাদী। তাঁর নিরলস পরিশ্রম এবং মানবিক মূল্যবোধ সমাজে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আব্দুল জব্বার অবিভক্ত বাংলায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোবারক আলী এবং মাতা লুৎফুন্নেছা বেগম। তাঁর পিতা অঢেল ভূসম্পত্তির অধিকারী একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। আব্দুল জব্বার তাঁর পূর্ব পুরুষদের সামাজিক জনহিতকর কাজ দেখে দেখেই বড় হয়েছেন। তিনি কলকাতার স্বনামধন্য রিপন কলেজ থেকে আইএসসি এবং ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষার প্রতি গভীর আকৃষ্ট ছিলেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও অধ্যবসায় ও সততার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা অর্জন করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা পরবর্তীতে সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সম্পর্কে মামা অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পরবর্তীতে যিনি চিফ জাস্টিস হয়েছিলেন এবং তাঁর খালাতো ভাই ড. মোদাচ্ছের হোসেন ডিএলও এর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় চিফ জাস্টিস আব্দুস সাত্তার-এর ঢাকার আরমানি টুলাস্থ বাসায় ওঠেন। এবং এর কিছুদিন পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ফিসারি ডিপার্টমেন্টে অফিসার হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে চাকরি জীবন শুরু করেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কোণাগ্রাম সাহেব বাড়ি নিবাসী বর্তমানে যা নজিরাবাদ ইউনিয়নের নজিরাবাদ গ্রাম নামে পরিচিত, ওই গ্রামের কৃতী সন্তান আসাম আইন পরিষদের এমএলএ ও তৎসমের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নজির উদ্দিনের কন্যা খালেদা সুলতানা আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জব্বার-খালেদা দম্পতির পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা। আব্দুল জব্বার বিশ্বাস করতেন- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-।’ এই বিশ্বাস থেকে তিনি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে নিজ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সবসময় চিন্তা-ভাবনা করতেন। এই চিন্তা থেকেই সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যাপক আহমদ আলীসহ এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলেন। এর ধারাবাহিকতায় এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তিনি ‘দ্বীনি মজলিস’ নামে একটি সংগঠন করে তোলেন। এই সংগঠনে শিক্ষক মাওলানা মো. শওকত আলী, শিক্ষক মু. আব্দুর রহিম, অধ্যাপক আহমদ আলী, আব্দুল জব্বার, আব্দুল গফুর চৌধুরী, ডা. রেজওয়ানুল হক, কনু মিয়া ও ওয়াজেদ আলীসহ আরও অনেক ব্যক্তিবর্গ সদস্য ছিলেন। সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে আলোচনা করে ষোলঘর পুরাতন জামে মসজিদে বাদেশ্বরের মাওলানা জিয়াউল ইসলামের মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দ্বীনি শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠায় এটি নিয়মিত মক্তব হিসেবে চলতে থাকে। মাওলানা জিয়াউল ইসলামের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয় আব্দুল জব্বারের বাসায়। পরবর্তীতে তিনি মসজিদেই থাকতেন। দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব আব্দুল জব্বার খুব গভীরভাবে অনুভব করেন। সেই অনুভবের জায়গা থেকেই তিনি এলাকার মুরুব্বীগণের সাথে আলোচনা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকার মুরুব্বী ও সর্বস্তরের মানুষ দ্বীনি ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে একজন কামেল আলিম ফুলতলীর মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেবকে দিয়ে মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পূর্বে দোয়া ও আলোচনা মাহফিলের সিদ্ধান্ত হলে শিক্ষক মাওলানা শওকত আলীকে ফুলতলী সাহেবকে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ফুলতলী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে সুনামগঞ্জে আনার ব্যবস্থা করেন। এরপর ফুলতলী সাহেবের উপস্থিতিতে সুনামগঞ্জ ষোলঘরস্থ পুরাতন জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দ্বীনি মজলিসের সকল সদস্য, এলাকার মুরুব্বিয়ান ও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ওই সময় ফুলতলী সাহেব আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে দ্বীনি মজলিসের আহ্বানে একটি আলোচনা সভা হয়। ওই সভায় অধ্যাপক আহমদ আলীকে সভাপতি, আব্দুল জব্বারকে সেক্রেটারি এবং আব্দুর রহিম, ডা. করম আলী, মফিজুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মনিম পীর, মাওলানা শওকত আলী, আব্দুল গফুর চৌধুরী , রফিক আহমদ, চাঁন মিয়া, তোতা মিয়া ও মফিজ আলী প্রমুখকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। ষোলঘর পুরাতন জামে মসজিদের দক্ষিণ পাশে খালি জায়গায় তৎকালীন সময়ে ষোলঘরের প্রবীণ ব্যক্তি সাবেক এমপি ও পৌর চেয়ারম্যান আবু হানিফা আহমদ অসুস্থ অবস্থায় আব্দুল জব্বারের অনুরোধে মাদ্রাসার কাঁচাঘরের বাঁশের খুঁটি স্থাপন করেন। ষোলঘরের সর্বস্তরের মানুষ মাদ্রাসার ঘর তৈরিতে স্বেচ্ছায় সাহায্য - সহযোগিতা করেছেন। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটি / গভর্নিং বডিতে সভাপতি/ সদস্য হিসেবে অ্যাড. আব্দুর রউফ, অ্যাড. আফতাব উদ্দিন, গাজী শাহ, অ্যাড. মঈন উদ্দিন, অ্যাড. শাহারুল ইসলাম, একেএম মোর্শেদ, সোনাহর আলীহসহ অনেক গুণী ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকে এখনো করছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সুপার মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন আব্দুল্লাহ ও বর্তমান অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলীনূরসহ সকল শিক্ষক-কর্মচারী দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসাটিকে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। যা আজ ‘দ্বীনি সিনিয়র ফাজিল মডেল মাদ্রাসা’ হিসেবে স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রথিতযশা শিক্ষানুরাগী আব্দুল জব্বার আমৃত্যু ওই মাদ্রাসার অবকাঠামোগত ও শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক খরচাদি সাধ্যমতো নিজ থেকেই করেছেন। শুধু প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলাই নয়; তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এলাকায় শিক্ষার হার চোখে পড়ার মতো বেড়ে যায়। সুনামগঞ্জ অনগ্রসর এলাকা। পূর্ব থেকেই এখানে শিক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। বিশেষত নারী শিক্ষা। আব্দুল জব্বার মনেপ্রাণে অনুভব করতেন, নারী শিক্ষা শুধু নারীর অধিকার নয়, এটি সমাজের অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। এই অনুভূতি নিয়েই তিনি পর্যবেক্ষণ করেন বিশাল জনগোষ্ঠীর সুনামগঞ্জে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত একটিমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা জেলায় নারী শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই তিনি আরেকটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তীব্র তাড়না অনুভব করে। নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের তাড়না থেকেই তিনি আরেকটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হকের সাথে আলোচনা করে সুনামগঞ্জে আরও একটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রয়োজনীয়তা যে আছে, তা বোঝাতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মহকুমা প্রশাসকের সম্মতিতে শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মহকুমা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাপক আলোচনান্তে সুনামগঞ্জে নারী শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শহরে ‘সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং তা বাস্তবায়নের জন্য মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হককে সভাপতি, আব্দুল জব্বারকে সেক্রেটারি এবং দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, অ্যাড. রফিকুল বারী চৌধুরী, অ্যাড. আব্দুস সামাদ, অ্যাড. খলিলুর রহমান, আব্দুস সালাম, ধূর্জটি কুমার বসু, অ্যাড. ফজলুল হক আছপিয়া, অ্যাড. চাঁন মিয়াসহ শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্য ও শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ ও সহায়তায় বালিকা বিদ্যালয়টির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিদ্যালয়ের মাটি ভরাট ও ভবন নির্মাণকাজ স¤পন্ন করতে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার নিরলসভাবে সময় ও শ্রম দিয়ে যান। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অনেক দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী শিক্ষার আলো দেখতে পায়। তিনি সবসময় বিদ্যালয়ে যেতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। শিক্ষার মানোন্নয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বই-খাতা বিতরণ করেন। শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সকলের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় ‘সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ আজ জেলার অন্যতম বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শিশুদের আধুনিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে শহরে একটি কিন্ডারগার্টেন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষানুরাগীগণ অনুভব করেন। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী শিক্ষানুরাগী আব্দুল জব্বারসহ শহরের সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে সুনামগঞ্জ শহরে ‘আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতন’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল জব্বার সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় কিন্ডারগার্টেনটির ভবন পুনঃনির্মাণ ও বর্ধিতকরণসহ যাবতীয় কাজ অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে স¤পন্ন করেন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা লগ্নে শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা -কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে সচিব হিসেবেও তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার অনুমোদন সুদূর চিটাগাং ডিজি অফিস থেকে দক্ষতার সাথে নিয়ে আসেন। তিনি আমৃত্যু ওই কিন্ডারগার্টেনের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি স্কুলটির জিম্মা ট্রাস্টি বোর্ডেরও একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। সুনামগঞ্জ শহরে একটি মাত্র খেলার মাঠ ছিল। যা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সুনামগঞ্জের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মাত্র মাঠ কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। তাই শহরের শিক্ষার্থী ও তরুণদের জন্য একটি খেলার মাঠ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “খেলাধুলা মানুষকে শৃঙ্খলা, ধৈর্য, সহনশীলতা ও দলগত কাজ শিক্ষা দেয়।” এই বিশ্বাস থেকেই তিনি স্কুল - কলেজ - মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও এলাকার তরুণদের খেলাধুলার জন্য একটি বিকল্প খেলার মাঠ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করে একটি সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। সভাটি হয় শহরের বাজার মসজিদে। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল নজির আহমদ-এর সভাপতিত্বে ও আব্দুল জব্বার-এর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হক এর সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়। আলাপ আলোচনান্তে মহকুমা প্রশাসক মাঠ নির্মাণের পক্ষে সায় দেন। সরকারি বিধি মোতাবেক মাঠের জায়গা রিকুইজিশন করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের আওতায় গম বরাদ্দ করে খেলার মাঠ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বহু বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কঠোর পরিশ্রম ও তদারকির মধ্যে দিয়ে আব্দুল জব্বার সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় মাঠ নির্মাণ কাজ স¤পন্ন করেন। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হক, সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুল জব্বার এবং সদস্য ডা. করম আলী, চাঁন মিয়া, অ্যাড. আফতাব উদ্দিন প্রমুখ। সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেজন্য তিনি চিন্তা করতেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামিক স্কলারদের নিয়ে কীভাবে তাফসীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায় সেজন্য গুণীজনদের সাথে পরামর্শ করতেন। আব্দুল জব্বার ইসলাম দরদী সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাহায্য সহযোগিতায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কয়েকবার আন্তর্জাতিক খ্যাতি স¤পন্ন বক্তা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সুনামগঞ্জ ইসলামি তাফসীর মাহফিলে আসেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সুনামগঞ্জে যে কয়বার এসেছেন আব্দুল জব্বার ফিসারি অফিসারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সরশিনার গদিনিশীল পীর মাওলানা আবু জাফর সালে আহমদ (মাসুম সাহেব) ১৯৭৮ সালে সুনামগঞ্জে এসে মূল্যবান তাফসীর পেশ করেন। ওই সময় তিনি আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। জামায়াতে ইসলামের তৎকালীন আমির মাওলানা আব্দুর রহিম সুনামগঞ্জে কর্মী সমাবেশে যোগদান করেন এবং আব্দুল জব্বারের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম হাফেজে হুজুর সুনামগঞ্জে এসে তাফসীর পেশ করেন। ওই সময় তিনি আব্দুল জব্বার এর বাসায় অবস্থান করে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামিক স্কলার ইস্ট লন্ডন মসজিদের খতিব ও লন্ডনস্থ দারুল উম্মা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ মাওলানা আবু সাঈদ এবং লন্ডনস্থ বার্মিংহাম দারুল উম্মা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি স¤পন্ন বক্তা হাফেজ মাওলানা লুৎফুর রহমান সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে ইসলামিক সমাবেশে যোগদান করে মূল্যবান বয়ান পেশ করেন। ওই সময় তিনিও আব্দুল জব্বারের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আব্দুল জব্বার (ফিসারি অফিসার) সমাজের সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন সবসময়। তিনি সুন্দর সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৭৭ সালের কথা। আমবাড়ি গোপালপুর মাদ্রাসার নিকটবর্তী যোগীরগাঁও গ্রামে যাত্রাগান, মদ ও জুয়ার আসরের আয়োজন করা হয়। এতে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ আবেদনের মাধ্যমে তৎকালীন জেলা প্রশাসকে অবহিত করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য দোয়ারাবাজার থানাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু দোয়ারাবাজার থানা জেলা প্রশাসকের নির্দেশ পেয়ে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গোপালপুর মাদ্রাসার সহকারী মুহতামিম মাওলানা আবুল ফজল এলাকার মুসল্লিগণকে সাথে নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরে আব্দুল জব্বারের বাসায় যান। তাঁকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশ দেওয়া কাগজপত্র দেখান এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জন্য অনুরোধ করেন। তখন রাত সাড়ে ১১টা। আব্দুল জব্বার তৎক্ষণাৎ সকলকে নিয়ে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল ওয়াহাব সরকারের বাসায় গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিষয়টি অবগত করেন এবং অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল জব্বারের অনুরোধ উপেক্ষা না করে সুনামগঞ্জ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপের আয়োজনটি স¤পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন। এভাবে সমাজ সংস্কার ও উন্নয়নে আব্দুল জব্বার বহু নজির রেখে গেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা কিংবা খরা - যেখানেই মানুষ বিপদে পড়েছে, সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তিনি ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসা সহায়তা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অসংখ্য মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। তিনি মাদকবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সামাজিক সমস্যা, মানুষের দুর্দশা, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। সমাজ উন্নয়নে তাঁর আন্তরিকতা, সততা ও মানবিকতা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৫ সালে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহতের পর পটপরিবর্তনে দেশে আওয়ামী লীগ এমপিদের ধরপাকড় শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জে আব্দুজ জহুর এবং অ্যাডভোকেট আব্দুর রইছ এমপিকে গ্রেফতার করে সিলেট কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তৎকালীন সময়ে সরকার আদালতে উপস্থিত হয়ে রাজসাক্ষী দেওয়ার জন্য আব্দুল জব্বার ও সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নানকে তলব করে। আব্দুল জব্বার যথাসময়ে সিলেট জজ কোর্টে উপস্থিত হয়ে আব্দুজ জহুর এবং অ্যাডভোকেট আব্দুর রইছ এর ওপর উনার বক্তব্য-জবানবন্দী পেশ করে স্পষ্টভাবে আদালতে বলেন, “আব্দুজ জহুর এবং আব্দুর রইছ উনারা সুনামগঞ্জের জনগণের নেতা ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তাঁরা মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ও অভিযোগ কেউ তুলতে পারবে না। আদালত তাঁর বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদেরকে মুক্তি দেন।” আব্দুল জব্বার ছিলেন বিনয়ী, পরিশ্রমী ও নীতিবান ব্যক্তি। তিনি কখনও নিজের কাজের প্রচার চাননি; বরং নীরবে কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানুষের জন্য কাজ করাই জীবনের প্রকৃত সফলতা।” তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপন ও সৎ মনোভাব সকলের কাছে তাঁকে ভালোবাসার মানুষে পরিণত করে। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজের জন্য কাজ করে গেছেন। আব্দুল জব্বারের শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকা- আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আজকের সমাজে যখন স্বার্থপরতা ও অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট, তখন তাঁর মতো মানুষ আমাদের আশা ও প্রেরণার আলো দেখান। তাঁর কর্ম, আদর্শ ও অবদান আজও সমাজে জীবন্ত। আশা করবো, তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম সমাজের কল্যাণে এগিয়ে আসবে। আব্দুল জব্বারের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
[লেখক : প্রভাষক, জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজ, ছাতক, সুনামগঞ্জ]