
বাংলাদেশের জ্বালানিখাতে এক সম্ভাবনাময় অধ্যায়ের নাম ছিল টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র। অথচ মাত্র দুটি বিস্ফোরণ এবং দুই দশকের প্রশাসনিক অবহেলায় এই জাতীয় সম্পদ আজ প্রায় চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন কানাডিয়ান কো¤পানি নাইকো রিসোর্সেস-এর ভুল ড্রিলিংয়ের কারণে বিস্ফোরণের মাধ্যমে একটিমাত্র নয়, একে একে ধ্বংস হয় গ্যাস, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, স্থানীয় অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় আস্থা - সবকিছু।
দু’দফা বিস্ফোরণের সময় গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসা আগুনের ভয়াবহতা ছিল এমন, যার শিখা ছুঁয়েছিল ৩০০ ফুট পর্যন্ত। টেংরাটিলা ও আশপাশের গ্রামের মানুষ আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু গ্যাস নয়, বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষিজমি, গাছপালা, পানির স্তর ও স্থানীয় জনস্বাস্থ্য। এমনকি এখনো এলাকাবাসী নলক‚পের আয়রনযুক্ত পানির কষ্ট আর নানা রোগব্যাধি নিয়ে বেঁচে আছেন এক অনিশ্চয়তায়।
এই গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংসের ঘটনায় দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও বিগত দুই দশকে আমরা দেখেছি শুধুই নীরবতা। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ ৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা থাকলেও তা আজো আদায় হয়নি। মামলাটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
একসময় এই গ্যাসক্ষেত্র ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে স্বপ্ন জেগেছিল - এলাকায় হবে শিল্প কারখানা, চাকরির সুযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দুই দশকেও একটি জিওলজিক্যাল জরিপ পর্যন্ত স¤পন্ন হয়নি। পুনঃখননের ঘোষণা আসেনি, বরং অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মেশিনপত্র, ধ্বংস হচ্ছে সম্ভাবনার চিহ্নগুলো।
এখন সময় এসেছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার। টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র জাতীয় স¤পদ। এটির প্রতি অবহেলা মানেই জনগণের প্রতি অবিচার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি চরম অন্যায়। সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এই গ্যাসক্ষেত্র পুনরায় খনন করা হবে কিনা, এবং এর ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করা হবে কিনা।
দেশ বর্তমানে জ্বালানী সংকট মোকাবিলা করছে। এই সংকট লাঘবে টেংরাটিলা হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান। বাপেক্স যদি সত্যিকার অর্থে দায়িত্ব নেয় এবং রাষ্ট্র এই ইস্যুতে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করে - তাহলে শুধু টেংরাটিলাই নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি জনগণের বিশ্বাসও ফিরবে।
আমরা মনে করি, দ্রুত একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র পুনঃখনন, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ কার্যক্রম শুরু করা উচিত, এবং এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি গণমাধ্যম ও জনগণের সামনে উন্মুক্ত রাখা জরুরি। অন্যথায়, টেংরাটিলা হবে ইতিহাসের ভয়াবহ উদাহরণ- যেখানে দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় বিলীন হয়ে গেছে একটি দেশের অমূল্য সম্পদ।