
আশিস রহমান ::
দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র, এটি ছিল দেশের অন্যতম জ্বালানী সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাবনাময় ভান্ডার। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি এবং ২৪ জুন, হাওর ও টিলাবেষ্টিত নির্জন অঞ্চলে দু’দফা বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা এলাকা। বিস্ফোরণ হয় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে, যার আগুনের উচ্চতা ছিল আকাশচুম্বী। আর এ ঘটনাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশে জাতীয় সম্পদ বিনাশের সবচেয়ে আলোচিত ও নিন্দিত উদাহরণ।
গত ২৪ জুন মঙ্গলবার টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড ট্র্যাজেডির ২০ বছর পূর্তি হয়েছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে আজোবধি সেই গ্যাসক্ষেত্রটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘ দুই দশকেও এর ক্ষয়ক্ষতির সুষ্ঠু বিচার হয়নি, নেওয়া হয়নি গ্যাসক্ষেত্রটি পুনরায় খননের উদ্যোগ।
২০০৫ সালের বিস্ফোরণ : ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারিতে কানাডিয়ান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী কোম্পানি নাইকো’র ভুল ড্রিলিংয়ের কারণে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। প্রথম দফা এই বিস্ফোরণে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বের হতে থাকে গ্যাসের প্রবাহ। বাড়তে থাকে গ্যাসের চাপ। এই প্রবাহ ও চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রথম বিস্ফোরণের স্থান থেকে ১০০ মিটার পশ্চিমে দ্বিতীয়বারের মতো রিলিফ কূপ খননের কাজ শুরু করে নাইকো। খননকাজ চলাকালেই ২৪ জুন রাতে রিলিফ কূপে দ্বিতীয় দফা অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে যে উদ্দেশ্যে খননকাজ পরিচালনা করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে ভেস্তে যায়। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় গ্যাসের চাপ। এসময় মূল রিগের চারপাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে গ্যাস বের হতে-হতে দ্বিতীয় দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনের লেলিহান শিখা ২৫০-৩০০ ফুট উচ্চতায় উঠানামা করে। এসময় আতঙ্কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিগি¦দিক পালাতে থাকে টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরিশনগর, খৈয়াজুরি, আলীপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। এতে টেংরাটিলার দুটি গ্যাস কূপ ধ্বংস হয়, পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার মূল্যবান রিজার্ভ গ্যাস, গাছপালা ও স্থানীয় সম্পদ।
পরিবেশ ও জনজীবনে প্রভাব : বিস্ফোরণের ফলে গ্যাস ও আগুনে আশপাশের অন্তত কয়েক কিলোমিটার এলাকার স্থানীয় কৃষিজমি ও বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে নেমে আসে পরিবর্তন। ফলে খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। এছাড়াও নলকূপের পানিতে আয়রনের উপস্থিতি বেড়ে যায়। গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে এলার্জি, আর্সেনিক, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন চর্মরোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এলাকাবাসী এখনও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
২০০৫ থেকে আজ পর্যন্ত : ২০০৫ সালের দু’দফা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের পর থেকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে গেছে। এই ঘটনায় দেশে ও বিদেশে দুইটি মামলা হয়। নাইকোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে সরকার। বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ী নয় উল্লেখ করে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটে’ (ইকসিড) সালিশি মোকদ্দমা করে নাইকো। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একটি সমীক্ষা চালায় বাপেক্স। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাইকোর কাছে বাপেক্স ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং বাংলাদেশ সরকার ৮৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইকসিডে নালিশ জানায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালটি নাইকোকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় দেন। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। যদিও এ ক্ষতিপূরণ এখনো পাওয়া যায়নি। মামলাটির দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এখন থেমে আছে। এদিকে দুই দশকেও টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটির জিওলজিক্যাল জরিপ, নিরাপদ কূপ পুনঃখনন বা গ্যাস উত্তোলন কাজ শুরুর কোনো ঘোষণা নেই। বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত টেংরাটিলাকে পূর্ণ উদ্ভাবন বা পুনঃশক্তির পরিকল্পনায় আনেনি। গ্যাস ও খনিজ স¤পদ পুনরুদ্ধারে সরকারি কার্যক্রম একেবারেই স্থবির। এদিকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গ্যাস ক্ষেত্রের মূল্যবান মালামাল ও সরঞ্জাম বিনষ্ট হচ্ছে।
নাইকো দুর্নীতি মামলা : রাজনৈতিক হাতিয়ার? ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি দেওয়া হয়। ওই চুক্তি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আটজনকে আসামি করে নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াসহ বাকিসব আসামিকে খালাস দেন ঢাকার একটি আদালত। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাইকো দুর্নীতির মামলাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। এ মামলা ব্যবহার করে আওয়ামীলীগ সরকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। অথচ আওয়ামী লীগের টানা প্রায় পনেরো বছরের শাসনামলে টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড ট্র্যাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ বা জাতীয় সম্পদ রক্ষায় কোনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করতে দেখা যায়নি। নেওয়া হয়নি গ্যাসক্ষেত্র পুনঃখননের উদ্যোগ।
প্রশাসন ও স্থানীয়রা যা বলছেন: টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড ট্রাজেডির ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
টেংরাটিলা গ্রামের বাসিন্দা হাছান আলী বলেন, সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি মনে হলে এখনো আৎকে উঠি। আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেলো কোটি কোটি টাকার মূল্যবান গ্যাস। একই গ্রামের মোস্তফা মিয়া বলেন, আমরা আশায় ছিলাম গ্যাস আবার উঠবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। এলাকায় শিল্পকারখানা হবে। বেকারত্ব দূর হবে। কিন্তু গত ২০ বছরে কিছুই হয়নি।
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, টেংরাটিলা বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের এক বিশাল ভা-ার। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এখনো সময়মতো হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আরেকটি সম্ভাবনাময় জাতীয় সম্পদ চিরতরে হারিয়ে যাবে। দ্রুত এই গ্যাসক্ষেত্রটিকে সরকারিভাবে পুনঃখনন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানাই।
বাপেক্স-এর উপমহাব্যবস্থাপক ও টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডের ইনচার্জ প্রকৌশলী এম. এম. নাজিম উদ্দিন জানান, টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড আগে যেই অবস্থায় ছিলো এখনো সেই অবস্থায় আছে। নাইকো চলে যাওয়ার পর এখন আমরা এটি দেখাশোনা করছি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরূপ রতন সিংহ বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকোর সাথে মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটি দীর্ঘদিন নাইকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। গতবছর নতুন করে গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্স এটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এখনো এটি বাপেক্সের নিয়ন্ত্রণেই আছে। এখন আবার নতুন করে গ্যাস উত্তোলন করা হবে কী-না তা জানি না। তবে বাপেক্সের মাধ্যমে গ্যাস ক্ষেত্রটি পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া গেলে দেশের জ্বালানী সংকট অনেকটাই লাঘব হবে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র, এটি ছিল দেশের অন্যতম জ্বালানী সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাবনাময় ভান্ডার। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি এবং ২৪ জুন, হাওর ও টিলাবেষ্টিত নির্জন অঞ্চলে দু’দফা বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা এলাকা। বিস্ফোরণ হয় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে, যার আগুনের উচ্চতা ছিল আকাশচুম্বী। আর এ ঘটনাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশে জাতীয় সম্পদ বিনাশের সবচেয়ে আলোচিত ও নিন্দিত উদাহরণ।
গত ২৪ জুন মঙ্গলবার টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড ট্র্যাজেডির ২০ বছর পূর্তি হয়েছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে আজোবধি সেই গ্যাসক্ষেত্রটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘ দুই দশকেও এর ক্ষয়ক্ষতির সুষ্ঠু বিচার হয়নি, নেওয়া হয়নি গ্যাসক্ষেত্রটি পুনরায় খননের উদ্যোগ।
২০০৫ সালের বিস্ফোরণ : ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারিতে কানাডিয়ান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী কোম্পানি নাইকো’র ভুল ড্রিলিংয়ের কারণে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। প্রথম দফা এই বিস্ফোরণে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বের হতে থাকে গ্যাসের প্রবাহ। বাড়তে থাকে গ্যাসের চাপ। এই প্রবাহ ও চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রথম বিস্ফোরণের স্থান থেকে ১০০ মিটার পশ্চিমে দ্বিতীয়বারের মতো রিলিফ কূপ খননের কাজ শুরু করে নাইকো। খননকাজ চলাকালেই ২৪ জুন রাতে রিলিফ কূপে দ্বিতীয় দফা অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে যে উদ্দেশ্যে খননকাজ পরিচালনা করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে ভেস্তে যায়। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় গ্যাসের চাপ। এসময় মূল রিগের চারপাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে গ্যাস বের হতে-হতে দ্বিতীয় দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনের লেলিহান শিখা ২৫০-৩০০ ফুট উচ্চতায় উঠানামা করে। এসময় আতঙ্কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিগি¦দিক পালাতে থাকে টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরিশনগর, খৈয়াজুরি, আলীপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। এতে টেংরাটিলার দুটি গ্যাস কূপ ধ্বংস হয়, পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার মূল্যবান রিজার্ভ গ্যাস, গাছপালা ও স্থানীয় সম্পদ।
পরিবেশ ও জনজীবনে প্রভাব : বিস্ফোরণের ফলে গ্যাস ও আগুনে আশপাশের অন্তত কয়েক কিলোমিটার এলাকার স্থানীয় কৃষিজমি ও বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে নেমে আসে পরিবর্তন। ফলে খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। এছাড়াও নলকূপের পানিতে আয়রনের উপস্থিতি বেড়ে যায়। গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে এলার্জি, আর্সেনিক, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন চর্মরোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এলাকাবাসী এখনও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
২০০৫ থেকে আজ পর্যন্ত : ২০০৫ সালের দু’দফা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের পর থেকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে গেছে। এই ঘটনায় দেশে ও বিদেশে দুইটি মামলা হয়। নাইকোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে সরকার। বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ী নয় উল্লেখ করে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটে’ (ইকসিড) সালিশি মোকদ্দমা করে নাইকো। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একটি সমীক্ষা চালায় বাপেক্স। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাইকোর কাছে বাপেক্স ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং বাংলাদেশ সরকার ৮৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইকসিডে নালিশ জানায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালটি নাইকোকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় দেন। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। যদিও এ ক্ষতিপূরণ এখনো পাওয়া যায়নি। মামলাটির দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এখন থেমে আছে। এদিকে দুই দশকেও টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটির জিওলজিক্যাল জরিপ, নিরাপদ কূপ পুনঃখনন বা গ্যাস উত্তোলন কাজ শুরুর কোনো ঘোষণা নেই। বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত টেংরাটিলাকে পূর্ণ উদ্ভাবন বা পুনঃশক্তির পরিকল্পনায় আনেনি। গ্যাস ও খনিজ স¤পদ পুনরুদ্ধারে সরকারি কার্যক্রম একেবারেই স্থবির। এদিকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গ্যাস ক্ষেত্রের মূল্যবান মালামাল ও সরঞ্জাম বিনষ্ট হচ্ছে।
নাইকো দুর্নীতি মামলা : রাজনৈতিক হাতিয়ার? ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি দেওয়া হয়। ওই চুক্তি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আটজনকে আসামি করে নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াসহ বাকিসব আসামিকে খালাস দেন ঢাকার একটি আদালত। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাইকো দুর্নীতির মামলাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। এ মামলা ব্যবহার করে আওয়ামীলীগ সরকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। অথচ আওয়ামী লীগের টানা প্রায় পনেরো বছরের শাসনামলে টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড ট্র্যাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ বা জাতীয় সম্পদ রক্ষায় কোনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করতে দেখা যায়নি। নেওয়া হয়নি গ্যাসক্ষেত্র পুনঃখননের উদ্যোগ।
প্রশাসন ও স্থানীয়রা যা বলছেন: টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড ট্রাজেডির ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
টেংরাটিলা গ্রামের বাসিন্দা হাছান আলী বলেন, সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি মনে হলে এখনো আৎকে উঠি। আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেলো কোটি কোটি টাকার মূল্যবান গ্যাস। একই গ্রামের মোস্তফা মিয়া বলেন, আমরা আশায় ছিলাম গ্যাস আবার উঠবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। এলাকায় শিল্পকারখানা হবে। বেকারত্ব দূর হবে। কিন্তু গত ২০ বছরে কিছুই হয়নি।
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, টেংরাটিলা বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের এক বিশাল ভা-ার। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এখনো সময়মতো হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আরেকটি সম্ভাবনাময় জাতীয় সম্পদ চিরতরে হারিয়ে যাবে। দ্রুত এই গ্যাসক্ষেত্রটিকে সরকারিভাবে পুনঃখনন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানাই।
বাপেক্স-এর উপমহাব্যবস্থাপক ও টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডের ইনচার্জ প্রকৌশলী এম. এম. নাজিম উদ্দিন জানান, টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড আগে যেই অবস্থায় ছিলো এখনো সেই অবস্থায় আছে। নাইকো চলে যাওয়ার পর এখন আমরা এটি দেখাশোনা করছি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরূপ রতন সিংহ বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকোর সাথে মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটি দীর্ঘদিন নাইকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। গতবছর নতুন করে গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্স এটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এখনো এটি বাপেক্সের নিয়ন্ত্রণেই আছে। এখন আবার নতুন করে গ্যাস উত্তোলন করা হবে কী-না তা জানি না। তবে বাপেক্সের মাধ্যমে গ্যাস ক্ষেত্রটি পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া গেলে দেশের জ্বালানী সংকট অনেকটাই লাঘব হবে।