
বাংলাদেশের প্রকৃতিসমৃদ্ধ এক বিস্ময় টাঙ্গুয়ার হাওর আজ নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়ছে। বর্ষা ও হেমন্তে দুই রূপে বিভোর এ হাওর এক সময় ছিল মিঠাপানির মাছ, পরিযায়ী পাখি ও জলজ জীববৈচিত্র্যের এক অপূর্ব আশ্রয়। অথচ আজ এই হাওর যেন নিজেরই মানুষের হাতে আক্রান্ত - প্রকৃতি, পরিবেশ ও স¤পদ হারিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এক সময়কার দুই লাখ পাখির বিচরণভ‚মি আজ সংকুচিত হয়ে মাত্র ২৩ হাজার পরিযায়ী পাখির ভরসাস্থলে রূপ নিয়েছে। এ ক্ষয় শুধু সংখ্যার নয়, বরং আমাদের সামগ্রিক পরিবেশবোধ ও স¤পদ সংরক্ষণের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। হিজল-করচ গাছের জঙ্গল আজ উজাড়, জলজপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয় নেই, ধ্বংস হয়েছে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র, হারিয়েছে দেশীয় মাছ, বন আর প্রাণবৈচিত্র্য। এ যেন ‘জলের মরুভ‚মি’।
এ সংকটের মূলেই আছে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, অনুমোদনহীন হাউসবোট, ইঞ্জিনচালিত নৌকার বেপরোয়া চলাচল, উচ্চশব্দে গান-বাজনা, ওয়াচ টাওয়ারে জনসমাগম, নোংরা বর্জ্য ও দূষণ। এটি শুধু টাঙ্গুয়ার পরিবেশ নয়, দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইটের মর্যাদাকেও বিপন্ন করে তুলছে।
আইইউসিএন-এর রক্ষণাবেক্ষণ শেষ হওয়ার পর থেকে হাওরটি কার্যত অভিভাবকহীন। প্রশাসনিক নজরদারির অভাব, দুর্বল নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতায় হাওর আজ পর্যটননির্ভর আয়ের এক হঠকারী ফাঁদে আটকে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়? আমরা মনে করি, প্রথমত, পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার জরুরি। পর্যটন বন্ধ না করেও তা হতে হবে পরিবেশবান্ধব ও সীমিত। হাওরের মূল এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিষিদ্ধ, হস্তচালিত নৌকা উৎসাহিত করতে হবে। হাউসবোট অনুমোদনের ক্ষেত্রে কঠোর মানদন্ড আরোপ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাস্তবসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ পরিকল্পনা চাই। স্থানীয় মানুষকে স¤পৃক্ত করে গঠন করতে হবে একটি সক্রিয় মনিটরিং টাস্কফোর্স, যাতে প্রশাসন, পরিবেশবিদ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও গণমাধ্যম একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
তৃতীয়ত, হাওরের চারপাশে গাছপালা রক্ষা ও পুনঃবনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। চায়না দুয়ারি জাল, বৈদ্যুতিক শকসহ ধ্বংসাত্মক মাছ ধরার সব পদ্ধতি নিষিদ্ধ করে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে হবে। চতুর্থত, হাওরকেন্দ্রিক ব্যবসা ও ইজারা সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে সুশাসনের আওতায় আনতে হবে। স্থানীয়দের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা হাওর ধ্বংস করে জীবিকা নির্বাহে বাধ্য না হয়।
আমরা মনে করি, টাঙ্গুয়ার সংকট কেবল একটি হাওরের সংকট নয়, এটি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক স¤পদ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতি যত বড়, তা একদিন শেষও হয়ে যেতে পারে- যদি আমরা অবহেলা করি। সরকার, প্রশাসন, স্থানীয় মানুষ, পরিবেশবাদী সংস্থা ও গণমাধ্যম - সবার একযোগে কার্যকর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। নয় কুড়ি কান্দা, ছয় কুড়ি বিলের টাঙ্গুয়াকে আজই বাঁচাতে হবে, না হলে আগামী প্রজন্ম শুধু এর গল্পই শুনবে, রূপ দেখবে না কখনও।